প্রতিহিংসা আমাদের ক্ষমা, পায়ের নীচে এনে বুকে হাঁটু গেড়ে বসে টুঁটি টিপে ধরে হাত জিভ বের করে তবে দয়া। রৌদ্র-শুষ্ক বীভৎসতা আমাদের সুন্দর-পূজা।
আমাদের যুক্তি-তর্ক নাই, কান্ডাকাণ্ডজ্ঞান নাই, আমরা খেয়ালি, অতি বড়ো পাষণ্ড নরাধম নারকী পশু। আমরা গাল খেয়ে বুক চাপড়াই, প্রশংসা শুনে মুখে থুথু দি।
নরকের রাজা যে-কাজ করতে শিউরে উঠে, আমরা হাসতে হাসতে তা করে যাই।
আমরা অবিনশ্বর। আমাদের একজন যায়, একশো জন আসে। আমাদের একবিন্দু রক্ত ভূতলে পড়লে একলক্ষ বিদ্রোহী নাগশিশু বসুমতী বিদীর্ণ করে উঠে আসে। আমরা অদম্য। আমাদের একজন বাঁধা পড়লে একশো জন ছাড়া পায়, সহস্র ভুজঙ্গ ছুটে এসে তার স্থান পূর্ণ করে।
আমরা দেশ-শত্রু বিভীষণের মহাকালান্তক কাল। আমরা অকাট্য ব্রহ্মশাপ! পরীক্ষিতের মতো, লখিন্দরের মতো দুর্ভেদ্য ছিদ্রহীন দুর্গের মধ্যে থাকলেও দেশবিদ্রোহীকে আমরা তক্ষক হয়ে, সূত্ররূপী কালসাপ হয়ে দংশন করে মারি।
আমাদের বিদ্রোহ যারা দেশ জয় করেছে তাদের উপর নয়, আমাদের বিদ্রোহ দেশদ্রোহীদের উপর। যখন আইরিশ তরুণ দেশদ্রোহী রবার্ট এমেটকে ফাঁসি দিয়ে তাকে তিন খণ্ড করে কেটে রাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল এবং তার সেই খণ্ডিত দেহে লেখা হয়েছিল, ‘How a traitor should be treated’ – দেখো, দেশদ্রোহীর দুর্দশা – সেই দুর্দশার কথা স্মরণ করো, হে দেশদ্রোহী মাতৃহন্তা বিভীষণের দল
তোমাদের নামে শেষ ঘন্টা বেজেছে মায়ের রক্ত-মন্দির অঙ্গনে। তোমাদের বিরুদ্ধে অসুর-নাশিনী দনুজ-দলনী মা-র রক্ত-তৃষাতুর জিহ্বা লক-লক করে উঠেছে।
এসো আমার মণিহারা কালফণীর দল, তোমাদের প্রেমের কেতকী-কুঞ্জ ছেড়ে অন্ধকার বিবর ত্যাগ করে। এসো মায়ের আমার শ্মশান-শায়িত আঘাত-জর্জরিত মৃত্যু শয্যা পার্শ্বে। হয় মৃত-সঞ্জীবনী আনো, নয় ভালো করে চিতাগ্নি জ্বলে উঠুক! বলো, মাভৈঃ! মাভৈঃ! ! বলো –
হর হর শংকর
বলো, জয় ভৈরব জয় শংকর
জয় জয় প্রলয়ংকর
শংকর ! শংকর!!
মন্দির ও মসজিদ
‘মারো শালা যবনদের!’ ‘মারো শালা কাফেরদের!’ – আবার হিন্দু মুসলমানি কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথা-কাটাকাটি, তারপর মাথা-ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম – তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরানির নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে, – ‘বাবা গো, মা গো!’ – মাতৃপরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে!
দেখিলাম, হত-আহতদের ক্রন্দনে মসজিদ টলিল না, মন্দিরের পাষাণ দেবতা সাড়া দিল না। শুধু নির্বোধ মানুষের রক্তে তাহাদের বেদি চিরকলঙ্কিত হইয়া রহিল।
মন্দির-মসজিদের ললাটে লেখা এই রক্তকলঙ্ক-রেখা কে মুছিয়া ফেলিবে, বীর?
ভবিষ্যৎ তাহার জন্য প্রস্তুত হইতেছে!
সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম-মাতালদের আড্ডা ওই মন্দির-মসজিদ-গির্জা ভাঙিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজ-তলে লইয়া আসিবেন।
জানি, স্রষ্টার আপনি-মোড়ল ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি’রা হ্যাট খুলিয়া, টুপি তুলিয়া, টিকি নাচাইয়া আমায় তাড়না করিবে, তবু ইহাদের পতন হইবে। ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।
পুসিফুট জনসন মাতালদের বিরুদ্ধে অভিযান করিয়া বহু মার খাইয়াছেন।
মুহম্মদকে যাহারা মারিয়াছিল, ইশা-মুসাকে যে-সব ধর্ম-মাতাল প্রহার করিয়াছিল, তাহাদেরই বংশধর আবার মারিতেছে মানুষকে – ইশা-মুসা মুহম্মদের মতো মানুষকে!
যে-সব অবতার-পয়গম্বর মানুষের মার হইতে মানুষকে বাঁচাইতে আসিয়া মানুষের মার খাইয়া গেলেন, তাঁহারা আজ কোথায়? মানুষের কল্যাণের জন্য আসিয়াছিলেন যাঁহারা, তাঁহাদেরই মাতাল পশু শিষ্যেরা আজ মানুষের সর্ব অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠিল।
যিনি সকল মানুষের দেবতা, তিনি আজ মন্দিরের কারাগারে, মসজিদের জিন্দানখানায় গির্জার gaol-এ বন্দি। মোল্লা-পুরুত, পাদরি-ভিক্ষু জেল-ওয়ার্ডের মতো তাহাকে পাহারা দিতেছে। আজ শয়তান বসিয়াছে স্রষ্টার সিংহাসনে।
একস্থানে দেখিলাম, ঊনপঞ্চাশ জন ভদ্র-অভদ্র হিন্দু মিলিয়া একজন শীর্ণকায় মুসলমান মজুরকে নির্মমভাবে প্রহার করিতেছে, আর একস্থানে দেখিলাম, প্রায় ওই সংখ্যাক মুসলমান মিলিয়া একজন দুর্বল হিন্দুকে পশুর মতো মারিতেছে। দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল অসহায় মানুষ। ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জংলি বর্বরেরা শূকরকে খোঁচাইয়া মারে। উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শূকরের চেয়েও কুৎসিত! হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ!
উহাদের দুই দলেরই নেতা একজন, তাহার আসল নাম শয়তান। সে নাম ভাঁড়াইয়া কখনও টুপি পরিয়া পর-দাড়ি লাগাইয়া মুসলমানদের খ্যাপাইয়া আসিতেছে, কখনও পর-টিকি বাঁধিয়া হিন্দুদের লেলাইয়া দিতেছে, সে-ই আবার গোরা সিপাই গুর্খা সিপাই হইয়া হিন্দু-মুসলমানদের গুলি মারিতেছে! উহার ল্যাজ সমুদ্রপারে গিয়া ঠেকিয়াছে, উহার মুখ সমুদ্রপারের বুনো বাঁদরের মতো লাল!