মিথ্যাকে মিথ্যা বললে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বললে যদি নির্যাতন ভোগ করতে হয়, তাতে তোমার আসল নির্যাতন ওই অন্তরের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। প্রাণের আত্মপ্রসাদ যখন বিপুল হয়ে ওঠে, তখন নির্যাতকের আগুন ওই আনন্দের এক ফুঁতে নিবে যায়। ইব্রাহিম যখন বিদ্রোহী হয়ে নমরুদের অত্যাচারকে অত্যাচার আর তার মিথ্যাকে মিথ্যা বলে প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন, তখন নমরুদ তাঁকে ধরে এক বিরাট অগ্নি-জাহান্নমের সৃষ্টি করে তাতে নিক্ষেপ করলে। কিন্তু ইব্রাহিমের কোথাও ফাঁকি ছিল না বলে, সত্যের জোর ছিল বলে তাঁর আত্মপ্রসাদ ওই বিপুল আনন্দের এক ফুঁতে সমস্ত জাহান্নম ফুল হয়ে হেসে উঠল। ইব্রাহিমের মনে যদি এতটুকু ফাঁকি থাকত, তবে তখনই নমরুদের আগুন তাঁকে ভস্মীভূত করে দিত।
ভগবানের বুকে লাথি মারবার অসমসাহসিকতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন মহাবিদ্রোহী ভৃগু। কেননা সে তাঁকে বোঝেনি, তাঁর ভুলকে ভুল বলে শোধরাবার চেষ্টা করেছিল, ভগবান যখন তা শুনলেন না, ঘুমিয়ে রইলেন তখন ভৃগু ভগবানের বুকে লাথি মেরে জাগালে। ভগবানও ভৃগুর পদ-চিহ্ন সগৌরবে বক্ষে ধারণ করলেন। ভাবতে চক্ষে জল আসে। কিন্তু ভগবানের যারা বিদ্রোহী নয়, গো-বেচারি ভক্ত, ভগবানকে প্রভু ভেবে জনম-জনম কাটিয়ে দিলে সাধনায়, তাদেরে হয়তো সিদ্ধি তিনি দিলেন, কিন্তু তাদের কারুর পদাঘাতকে তো বুকে ধারণ করে দেখালেন না। এর আসল মানে হচ্ছে, সত্যকে জানবার যার বিপুল সত্য ইচ্ছা থাকে, তার আঘাতও সহ্য করে, বুকে করে নিয়ে তার সত্য-নিষ্ঠা, সত্য জাগাবার আকাঙ্ক্ষাকে জগতের ভীরু কাপুরুষ ভণ্ড-ভক্তদের চোখের সামনে দেখায় যে, এই ফাঁকির পূজারির ক্রন্দনে সত্য জাগে না। সত্যকে জাগাবার জন্য বিদ্রোহ চাই, নিজেকে শ্রদ্ধা-প্রশংসার লোভ থেকে রেহাই দেওয়া চাই।
বিষ-বাণী
মাভৈঃ! মাভৈঃ!! ভয় নাই, ভয় নাই – ওগো আমার বিষ-মুখ অগ্নি-নাগ-নাগিনিপুঞ্জ! দোলা দাও, দোলা দাও তোমাদের কুটিল ফণায় ফণায়। তোমাদের যুগ যুগ-সঞ্চিত কাল-বিষ আপন আপন সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে ফেলো। তোমাদের বিভূতি-বরণ অঙ্গ কাঁচা বিষের গাঢ় সবুজ রাগে রেঙে উঠুক। বিষ সঞ্চয় করো, বিষ সঞ্চয় করো – হে আমার তিক্ত-চিত ভুজঙ্গ তরুণ দল! তোমাদের ধরবে কে? মারবে কে? যে ধরতে আসবে, তার হাড়-মাংস খসে খসে পড়বে উগ্র বিষের দাহনে। কোন্ দুঃসাহসী বন্দী করবে তোমাদেরে? কারার লৌহদণ্ড দারুণ বিষ-দাহনে খসে গলে পড়বে। অত্যুগ্র নিশ্বাস-বহ্নিতে কারার কন্দরে-কন্দরে ধুধু ধুধু করে আগুন – আগুন জ্বলে উঠবে। তোমার তড়িৎ-জিহ্বার মুহূর্ত-ইঙ্গিতে জল্লাদের হাতে খড়্গ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, ফাঁসির রজ্জু ভস্ম হয়ে যাবে। বিষ সঞ্চয় করো, হে আমার হলাহল-পুরবাসী কূটনাগ-নাগিনিকুল। এত – বিষ এমন বিষ – যা শুধু জ্যান্ত অবস্থাতেই অত্যাচারে দগ্ধে মারবে না, মরবার পরও যে বিষ শ্বাশত সম-তেজা সম-উগ্র হয়ে থাকবে। নিদাঘ মধ্যাহ্নের তাপ-দগ্ধ রুদ্র-বৈশাখী ঝড়ে ঝড়ে চিতায়-ভস্মীভূত তোমাদের বিষ স্ফুলিঙ্গ উড়ে বেড়াবে দিগন্তের কোলে কোলে – গৃহীর প্রাঙ্গনে প্রাঙ্গনে, বলদর্পীর মহলে-মহলে। মা ডুকরে কেঁদে উঠবে, আর বিষ-জ্বালায় শিশু-পুত্র তার আর্তনাদ করে করে নীল হয়ে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়ে মাতৃক্রোড়ে মরতে থাকবে, যেমন কারবালা কচি শিশু আসগর ‘তৃষ্ণা তৃষ্ণা’ করে জহরমাখা তীর খেয়ে মরেছিল!
তোমাদের গোরস্থানে তোমাদের শ্মশানে বিষ-বায়ু দিনে ঘূর্ণিরূপে শিস দিয়ে ঘুরে বেড়াবে আর রাতে অনির্বাণ আলেয়া-শিখা হয়ে নেচে নেচে বেড়াবে। ওই শ্মশানে, ওই গোরস্থানে যে যাবে, সে আর জ্যান্ত ফিরে আসবে না।
মরেও তোমাদের বিষ যাবে না, প্রতি অস্থিকণায়, প্রতি মৃত্তিকা-পরমাণুতে তোমাদের উদ্গারিত কূট-হলাহল মিশ্রিত থাকবে। সে-অস্থি যার গায়ে বিঁধবে, সে দগ্ধমৃত্তিকার যার গায়ে ছোঁয়া লাগবে সে তখনই বিষ-জর্জরিত, ভস্ম হয়ে যাবে। চাই এত জ্বালাময় হলাহল, এমনই মারিভয়-হানা মারিবিষ। তোমাদেরে দেহ হবে সহস্র বৃশ্চিক কোটি হুল-বহুল। যে তোমাদেরে বাঁধতে আসবে, ওই সহস্র বৃশ্চিক-যুক্ত কোটি হুল একসাথে তাকে উগ্র রোষে দংশন হানবে।
* * *
আমাদের কাছে প্রেম ভণ্ডামি, করুণা বিদ্রুপ, প্রণয় কশাঘাত, প্রীতি ভীরুতা।
আমাদের বিবাহের লাল চেলি দেশশত্রুর রক্ত-রাঙা উত্তরীয়, ভীম-তরবারি আগ্নেয়াস্ত্র আমাদের শয়নসাথি, ফাঁসির রশি আমাদের প্রিয়ার ভুজবন্ধন।
মড়ামুখ দেখে আমাদের গৃহত্যাগ, রক্ত-ঝরা প্রাণ, ঝাঁঝরা-করা বক্ষ নিয়ে রণাঙ্গনে আমাদের আরাম-শয়ন। বুকে প্রতিদ্বন্দ্বীর বেয়নেটের সঙ্গিন-ঘাত, সে যেন আমার মাতৃহারা পুত্রের অভিমান-মার। স্কন্ধে ঘাতকের ভীম খড়্গাঘাত, সে যেন আমাদের প্রিয়ার কোল হতে দুষ্টু আদরিণী মেয়ের ঝাঁপিয়ে পড়া।
আমরা যাকে হিংসা করি, তাকে শুধু মেরেই ক্ষান্ত হই না, তার বক্ষ বিদীর্ণ করে কাঁচা হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খাই, তার মাংস নিয়ে লোফালুফি খেলি, তার রক্তে তৃষ্ণা মেটাই, তার হাড্ডিচূর্ণ দিয়ে নস্য নিই। তার মাথার খুলি আমাদের পানপাত্র, তার মগজ আমাদের প্রদীপের রওগান ।
আমরা শয়তানের চেয়েও ক্রূর, পিশাচের চেয়েও নির্মম অকরুণ, ভূত-প্রেত-ডাকিনী-যোগিনীর চেয়েও ভয়াল, সতীহারা শিবের চেয়েও উন্মাদ, ভৃগুর চেয়েও বিদ্রোহী।