আমাদের মা নাই। আমাদের মা দয়া করে আমাদের ছেলেবেলাতেই আমাদেরে ফেলে স্বর্গে গেছেন, তাঁরা আর করুণা করে কখখনো ফিরে আসবেন না। তাঁরা জানতেন আমরা সবাই ক্ষুদিরাম, আমাদেরে মায়া করে আমাদের মা-রা লক্ষ্মী ছেলে করে তোলেন নি, তাঁরা আমাদের পথের ধুলোয় ফেলে ক্ষুদিরামের নামে রেখে গেছেন।
ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে। তোমরা চিনতে পারছ না, মা, তোমরা মায়ায় আবদ্ধ। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাদের ক্ষুদিরামকে – তোমাদের ছেলেদেরে ছেড়ে দাও, ওরা আমাদের – আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দলের। ওরা মায়েদের নয়, ওরা ঘরের নয়, বনের। ওরা হাসির নয়, ফাঁসির। ওই যে কণ্ঠ হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরছ, ওই কণ্ঠে ফাঁসির নীল দাগ লুকানো আছে। ছেড়ে দাও মা, ছেড়ে দাও, ওরা তোমার নয় ; আমার নয়, ওরা দেশের, ওরা বলিদানের, ওরা পূজার!
কোথায় ভাই ক্ষুদিরাম? আঠারো মাসের পরে আসবে বলে গেছে, এসেওছ প্রতি ঘরে ঘরে। কিন্তু আঠারো বছর যে কেটে গেল ভাই, সাড়া দাও সাড়া দাও আবার, যেমন যুগে যুগে সাড়া দিয়েছ ওই ফাঁসি-মণ্ডপের রক্ত-মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তোমার সাথে আমাদের বারবার দেখাশোনা ওই ফাঁসি-পরা হাসিমুখে! আর একবার সাড়া দিয়েছিলে তুমি আয়র্ল্যাণ্ডে রবার্ট এমেট নামে। সেদিনও এমনই তরুণ বয়সে তুমি ফাঁসির কৃষ্ণ-আলিঙ্গন, খড়্গের সুনীল চুম্বন পেয়েছিলে। হারা-প্রিয়া ‘সারা’র আলিঙ্গনপরশ তোমার জন্য নয়, কমলার প্রসাদ তোমার জন্য নয়, তোমার প্রিয়ায় তুমি এমনই বারে বারে পাবে আবার বারে বারেই হারাবে, তোমার প্রিয়ার চেয়েও প্রিয়তম ওই ফাঁসির রশি। কোথায় কোন্ মাতৃ-বক্ষে, কোন্ ‘সারা’র কোন্ কমলার কুঞ্জে আপন ভুলেছ, হে ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা! সাড়া দাও। সাড়া দাও! এসো আবার ফাঁসিমঞ্চে, আর একবার নতুন করে আমাদের সেই চির-নূতন চির-পুরাতন গান ধরি –
আঠারো মাসের পরে
জনম নেব মাসির ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি!
একবার বিদায় দে মা ফিরে আসি।
ধূমকেতুর পথ
অনেকেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, ‘ধূমকেতু’-র পথ কী? সে কী বলতে চায়? এর দিয়ে কোন্ মঙ্গল আসবে ইত্যাদি।
নীচে মোটামুটি ‘ধূমকেতু’র পথনির্দেশ করছি।
প্রথম সংখ্যায় ধূমকেতুতে ‘সারথির পথের খবর’ প্রবন্ধে একটু আভাস দিবার চেষ্টা করেছিলাম, যা বলতে চাই, তা বেশ ফুটে ওঠেনি মনের চপলতার জন্য। আজও হয়তো নিজেকে যেমনটি চাই তেমনটি প্রকাশ করতে পারব না, তবে এই প্রকাশের পীড়ার থেকেই আমার বলতে-না-পারা বাণী অনেকেই বুঝে নেবেন – আশা করি। পূর্ণ সৃষ্টিকে প্রকাশ করে দেখাবার শক্তি হয়তো ভগবানেরও নেই, কোনো স্রষ্টারই নেই। মানুষ অপ্রকাশকে আপন মনের পূর্ণতা দিয়ে পূর্ণ করে দেখে।
সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথি এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।
আর এই বিদ্রোহ করতে হলে – সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, – আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ!
বলতে হবে, – যে যায় যাক সে, আমার হয়নি লয়!
কথাটা শুনতে হয়তো একটু বড়ো রকমের হয়ে গেল। একটু সহজ করে বলবার চেষ্টা করি। আর এইটাই ধূমকেতুর সবচেয়ে বড়ো বলা।
আমি যতটুকু বুঝতে পারি, তার বেশি বুঝবার ভান করে যেন কারুর শ্রদ্ধা না প্রশংসা পাওয়ার লোভ না করি। তা সে মহাত্মা গান্ধিরই মতো হোক আর মহাকবি রবীন্দ্রনাথেরই মতো হোক কিংবা ঋষি অরবিন্দেরই মতো হোক, আমি সত্যিকার প্রাণ থেকে যতটুকু সাড়া পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধির বাণীর আহ্বানে, ঠিক ততটুকু মানব। তাঁদের বাণীর আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে, তবে তাঁদের মানব না। এবং এই ‘মানি না’ কথাটা সকলের কাছে মাথা উঁচু করে স্বীকার করতে হবে। এতে হয়তো লোকের অনেক নিন্দা-বদনাম-অপবাদ শুনতে হবে, কিন্তু আমি আমার কাছে ঠিক থাকব। তাঁদেরে বা তাঁদের মতো ঠিক না বুঝেও যদি লোকের কাছে বলে বেড়াই যে, আমি গান্ধি-ভক্ত বা রবীন্দ্র-ভক্ত বা অরবিন্দ-ভক্ত, তাতে অনেকের শ্রদ্ধা-প্রশংসা লাভ করব, কিন্তু আসলে তো সেটা ফাঁকি দিয়ে নেওয়া। এতে অন্যকে প্রবঞ্চনা করে খুব বাহবা নিতে পারি, কিন্তু আমার অন্তরের দেবতা অর্থাৎ আমার আমি তো তাতে দিন দিন ক্লিষ্ট-পীড়িতই হয়ে উঠবে। অন্যায় করলে, পাপ করলে অন্তরে যে পীড়া উপস্থিত হয়, মানুষের সেইটুকুই সচেতন ভগবান, সেইটুকুই সত্য।