ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়েই তবে সত্যকে পাওয়া যায়। কোনো ভুল করছি বুঝতে পারলেই আমি প্রাণ খুলে তা স্বীকার করে নেব! কিন্তু না বুঝেও নয়, ভয়েও নয়। ভুল করছি বা করেছি বুঝেও শুধু জেদের খাতিরে বা গোঁ বজায় রাখবার জন্যে ভুলটাকেই ধরে থাকব না। তাহলে ‘ধূমকেতু’র আগুন সেই দিনই নিবে যাবে। একমাত্র মিথ্যার জলই ‘ধূমকেতু’-শিখাকে নিবাতে পারবে। তাছাড়া ধূমকেতুকে কেউ নিবাতে পারবে না।
‘ধূমকেতু’ কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্মই সবচেযে বড়ো ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোন্খানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনও অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না।
…দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধু তাই লক্ষ্য করে আমরা এই আগুনের ঝান্ডা দুলিয়ে পথে বাহির হলাম।
জয় প্রলয়ংকর!
ক্ষুদিরামের মা
ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময়ের একটা গানে আছে, ক্ষুদিরাম বলছে –
আঠারো মাসের পরে
জনম নেব মাসির ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি –
একবার বিদায় দে মা ফিরে আসি।
সেই হারা-ক্রন্দনের আশ্বাস-গান শুনে আজও অতি বড়ো পায়াঙ্গ মেয়েরও চোখে জল আসে, গা শিউরে ওঠে। আমাদের মতো কাপালিকেরও রক্ত-আঁখি আঁখির সলিলে টলটল করে ওঠে। কিন্তু বলতে পারো কি দেশের জননীরা, আমাদের সেই হারা ক্ষুদিরাম তোমাদের কার ঘরে এসেছে? তোমরা একবার তোমাদের আপন আপন ছেলের কণ্ঠের পানে তাকাও, দেখবে – তাদের প্রত্যেকের গলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির নীল দাগ। ক্ষুদিরাম ছিল মাতৃহারা। সে কোন্ মাকে ডেকে আবার আসব বলে আশ্বাস দিয়ে গেছে, কেঁদে গেছে, তা যদি বুঝতে বাংলার মা-রা, তাহলে তোমাদের প্রত্যেকটি ছেলে আজ ক্ষুদিরাম হত। ক্ষুদিরাম ছেলেবেলায় মা হারিয়ে – পেয়েছিল সারা দেশের মায়েদের। মায়ের স্নেহের ক্ষুধা তার মেটেনি, তোমাদের সকলকে মা বলে ডেকেও সে তৃপ্ত হয়নি, তাই আবার আসব বলে কেঁদে গেছে। এবার অভিমানী ছেলে মায়ের ঘরে আসবে না, মাসির ঘরে আসবে। কিন্তু অভিমানী হলে কী হয় মা, ও ছিল বোকা ছেলে, তাই বুঝতে পারেনি যে, মাসির ঘর বলে অভিমান করে যার ঘরে আসতে চেয়েছে, সেও যে মায়েরই ঘর। সবাই যে তার মা।
মায়ের সাড়া পায় নাই, মা-রা তাকে কোলে নেয়নি, তাই অভিমানে সে আত্মবলিদান দিয়ে আত্ম-নির্যাতন করে মায়েদের অনাদরের প্রতিশোধ নিয়েছে। যাবার বেলায় দস্যি ছেলে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে গেল না। হায় হতভাগা ছেলে! সে কাঁদবে কার জন্যে? যার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই, তার চোখের জল যে লজ্জা, তার কাঁদাটাও যে অপমান, মা। দস্যিছেলে সব চোখের জলকে কণ্ঠের নীচে ঠেলে রাখলে। ফাঁসি পরে নীলকণ্ঠ হবার আগেই ব্যথায় নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। প্রাণের তিক্ত ক্রন্দনের জ্বালা তার কেউ দেখলে না, দেখলে শুধু কিশোর ঠোঁটের অপূর্ব হাসি। ফাঁসি হতে আর দু-চার মিনিট বাকি, তখনও সে তার নিজের ফাঁসির রশির সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত যে, ফাঁসির রজ্জুতে মোম দেওয়া হয় কেন! তোমরা কী ভাবছ মা যে, কী সাংঘাতিক ছেলে বাপু! কিন্তু ছেলে যতই সাংঘাতিক হোক, সত্যি করে বলো দেখি মা, ওই মাতৃহারার তোমাদেরই মুক্তির জন্য ফাঁসিতে যাওয়ার কথা শোনার পরেও কি তোমরা নিজেদের দুলালদেরে বুকে করে শুয়ে থাকতে যন্ত্রণা পাও না? ওই মাতৃহারার মরা লাশ কি তোমাদের মা ছেলের মধ্যে এসে শুয়ে একটা ব্যবধানের পীড়া দেয় না? নিজের ছেলেকে যখন আদর করে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় যাবতীয় সামগ্রী খাওয়াও, নিবিড় স্নেহে বুকে চেপে ধরে শুয়ে ঘুম পাড়াও, একটু অসুখ করলে তেত্রিশ কোটি দেবতার পায়ে মাথা-মুড়-খোঁড়, তখন কি এই মাতৃহীন ক্ষুদিরামের কথা – তারই মতো আরও সব লক্ষ্মীছাড়া মাতৃহারাদের কথা মনে হয়ে তোমাদের বুকে কাঁটার মতো বেঁধে না? তোমাদের এত স্নেহ এত মায়া কি অনুশোচনায় লজ্জায় সংকুচিত হয়ে ওঠে না? বলো মা, উত্তর দাও! আজ ওই ক্ষুদিরামের মতো শত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে এসে তোমাদেরে তোমাদের মাতৃহৃদয়ের নামে জিজ্ঞাসা করেছে, উত্তর দাও! জানি মা, উত্তর দিতে পারবে না, মুখে কথা ফুটবে না। তুমি বলতে যাবে, কিন্তু অমনি তোমার মনের মা তোমার মুখ টিপে ধরবে। বোবা হয়ে যাবে মা, বোবা হয়ে যাবে, মুখ কালো হয়ে যাবে অনুতাপের দগ্ধ অনুশোচনায়।
মানুষের মন আর আত্মা এমনই বালাই মা যে, পরের দুঃখ দেখে তার নিজের ভোগ বিস্বাদ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে মা-দের। মাতৃহারা এক পাশে দাঁড়িয়ে জল-ছলছল চোখে যদি চায়, তাহলে তোমার হাত উঠবে না মা তোমার ছেলের মুখে কিছু তুলে দিতে, আপনি শিথিল হয়ে যাবে। এটাও সওয়া যায়। কিন্তু যদি কোনো মাতৃহারা বিদ্রোহ করে কারুর কাছে কিছু না চায়। মাথা উঁচু করে কোনো মায়ের ঘরের পানে না তাকিয়ে তার রুক্ষ কেশ লক্ষ্মীছাড়া মূর্তির রুদ্রকেতন উড়িয়ে চলে যায়, ডাকলেও ঘরের পানে তাকায় না, মায়ের ডাকে চোখ ছলছল না করে উলটো আত্মনির্যাতন করে তোমাদের চোখের সামনে, – তাহলে মায়ের মন কেমন করে ওঠে বলো দেখি? হে আমার দেশের জননীরা! তোমাদের কাছে এসেছে তেমনই বিদ্রোহী লক্ষ্মীছাড়া মাতৃহারার দল, তাদের হারানো ক্ষুদিরামকে খুঁজে নিতে। ভয় কোরো না, বিদ্রুপ কোরো না এদেরে মা, এরা ভিখারি ছেলে নয়। আমরা মায়ের বিদ্রোহী ছেলে, আমরা তোমাদের কাছে করুণ ভিক্ষা করতে আসিনি, আসবও না। আমরা এসেছি আমাদের দাবি নিয়ে, আমাদের হারানো ক্ষুদিরামকে ফিরে নিতে। সে যে আমাদের মাতৃহারার দলের, সে তোমাদের নয়, মা।