মানুষের, জাতির, দেশের যখন চরম অবনতি হয়, তখনই এইরূপ নরপিশাচ জালিমের আবির্ভাব অত্যাবশ্যক হইয়া পড়ে। মানুষ যখন নিজের প্রকৃতিদত্ত অধিকারের কথা ভুলিয়া যায়, শত বন্ধনের মধ্যে তাহার জীবনের গতি-চাঞ্চল্য হারাইয়া ফেলে, তখন তাহার আর মান-অপমান জ্ঞান থাকে না, প্রভুর দেওয়া দয়ার দানকে গোলামের মতো সে মহা-দান বলিয়া মাথায় তুলিয়া বরণ করিয়া লয় এবং তাহার ভৃত্য-জীবন সার্থক হইল মনে করে। তাহার মন এত ছোটো হইয়া যায়, তাহার আশা এত হেয় ও হীন হইয়া পড়ে যে, সে ভাবিতেও পারে না – যে দান মাথায় করিয়া আজ সে গৌরব অনুভব করিতেছে, যে দানকে সে শিরোপা করিয়া (অভিরুচি অনুসারে কখনও পেছনে নেজুরের মতো জুড়িয়া) মুক্ত-স্বাধীন বিশ্বের কাছে বক্ষ স্ফীত করিয়া বেড়াইতেছে, তাহার দাম এক কথায় ‘পাঁচ জুতি’।
মনুষ্যত্বের অবমাননা ও লাঞ্ছনা শুধু ভিক্ষুকের জাতিই হাসিমুখে নিজেদের গৌরব বলিয়া মানিয়া লইতে পারে। অন্তরে যাহারা ঘৃণ্য নীচ আর ছোটো হইয়া গিয়াছে, আত্মসম্মান-জ্ঞান যাহাদের এত অসাড়-হিম হইয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে জাগাইয়া তুলিতে চাই – এই ডায়ারের দেওয়া অপমানের মতো বজ্র-বেদন।
এই ডায়ারের মতো দুর্দান্ত কশাই সেনানী যদি সেদিন আমাদিগকে এমন কুকুরের মতো করিয়া না মারিত, তাহা হইলে কী আজিকার মতো আমাদের এই হিম-নিরেট প্রাণ অভিমান-ক্ষোভে গুমরিয়া উঠিতে পারিত – না, আহত আত্মসম্মান আমাদের এমন দলিত সর্পের মতো গর্জিয়া উঠিতে পারিত? কখনই না। আজ আমাদের সত্যিকার শোচনীয় অবস্থা সাদা চোখে দেখিতে পারিয়াছি এই ডায়ারেরই জন্য। ডায়ারের প্রচণ্ড পদাঘাত, পৈশাচিক খুন-খারাবি আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া আমাদের ঘৃণ্য হীন অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করিয়া দিয়াছে। আরও জানাইয়া দিয়াছে যে, – যে নিষ্ঠীবন মাথায় করিয়া প্রভুর দেওয়া যে চাপরাশ পরিয়া, যে ছিন্ন জুতার মালা গলায় দুলাইয়া আমরা আহাম্মকের মতো দুনিয়ার স্বাধীন জাতিদের সামনে দাঁড়াইয়া – গোলামির ঝুটা গৌরব দেখাইতে গিয়া শুধু হাস্যাস্পদ হইয়াছিলাম, তাহাতে কেহ আমাদের প্রশংসা তো করেই নাই, উলটো, আরও, ‘হট্ যাও গোলাম কা জাত’ বলিয়া অবলীলাক্রমে লাঠির গুঁতো, বুটের টক্কর লাগাইয়াছে। তাহারা স্বাধীন-আজাদ; তাহারা আমাদের এ-হীন নীচতা, এত হেয় ভীরুতা, এমন ঘৃণ্য কাপুরুষতাকে পা দিয়া মাড়াইয়া যাইবে না তো কি মাথায় তুলিয়া লইবে? অন্ধ আমরা, আমাদের অবস্থা দেখিতে পাইতেছিলাম না, – সে অন্ধত্ব ঘুচাইয়া দিয়াছে এই ডায়ার! আমাদের এই নির্লজ্জ কাপুরুষতাকে ভীম পদাঘাতে দূর করিয়া দিয়াছে এই জেনারেল ডায়ার! গোলামের সঙ্গে প্রভুর সম্বন্ধ কীরকম তাহাই সে নির্মম কঠোরভাবে জানাইয়া দিয়াছে। অন্য প্রতারকদের মতো গলায় পায়ে শৃঙ্খল পরাইয়া আদর দেখাইতে যায় নাই সে – সে নারীর সামনে উলঙ্গ করিয়া মেথরের হাতে বেত্র দিয়া তোমার পিঠের চামড়া তুলিয়াছে! গর্দানে পাথর চাপা দিয়া বুকের উপর হাঁটাইয়াছে, তাহাদের পায়ে তোমাদিগকে সিজ্দা করাইয়া ছাড়িয়াছে। – আর, তবে তোমরা জাগিতে পারিয়াছ। তোমাদিগকে জাগাইতে চাই এমনই প্রচণ্ড নির্মম কশাই-শক্তি! এত নির্মমভাবে, এমন পিশাচের মতো বেত্রাঘাত না করিলে তোমরা জাগিতে না, তোমরা মা-বোনদের সামনে উলঙ্গ করিয়া হাত-পা বাঁধিয়া পশুর মতো না পিটাইলে তোমাদের আত্মসম্মান-জ্ঞান ফিরিয়া আসিত না! ডায়ারের বুট এমন করিয়া তোমাদের কলিজা মথিত না করিয়া গেলে তোমাদের চেতনা হইত না। তোমার মুখের সামনে তোমার আত্মীয়-আত্মীয়ার মুখে এমনি করিয়া থুথু না দিলে তোমাদের মানব-শক্তি খেপিয়া উঠিত না! – তাই আজ আমরা ডায়ারকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিতেছি, ‘খোদা তোমার মঙ্গল করুন!’ তুমি যে মঙ্গল দিয়া গিয়াছ আমাদের সারা ভারতবাসীকে, তাহা আমরা কখনও ভুলিব না, আমরা নিমকহারামের জাতি নই। নিশ্চয়ই তুলিব তোমার স্মৃতিস্তম্ভ, মহৎ প্রতিহিংসারূপে নয়, প্রতিদান স্বরূপ। আজ আমাদের এ-মিলনের দিনে তোমাকে ভুলিতে তো পারব না ভাই! এই মহামানবের সাগরতীরে ভারতবাসী জাগিয়াছে – বড়ো সুন্দর মোহন মূর্তিতে জাগিয়াছে! সেই তোমার আনন্দের হত্যার দিনে, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হতভাগ্যদের রক্তের উপর দাঁড়াইয়া হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই গলাগলি করিয়া কাঁদিয়াছে। দুঃখের দিনেই প্রাণের মিলন সত্যিকার মিলন হয়। আজ আমাদের এ-মিলন যে স্বর্গের উপর ভিত্তি করিয়া নয় ভাই, আজ আমরা পরস্পর পরস্পরকে সমান ব্যথায় ব্যথী, একই মায়ের পেটের ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিয়াছি। কাঁদিয়াছি – গলা জড়াজড়ি করিয়া কাঁদিয়াছি। – আমাদের ভাইদের খুন-মাখানো সমাধির উপর দাঁড়াইয়া আমরা এক ভাই অন্য ভাইকে চিনিয়াছি, আর বড়ো প্রাণ ভরিয়াই গাহিয়াছি –
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে,
এমন ঘরের হয়ে পরের মতন
ভাই ছেয়ে ভাই কদিন থাকে!
আজ এসো ডায়ার, আমাদের এই মহামিলনের পবিত্র দৃশ্য দেখিতে তোমাকেও নিমন্ত্রণ করিতেছি। আজ ঈর্ষা-দ্বেষ ভুলিয়া গিয়াছে ভাই, তোমারই জন্য আমাদের বুকের আসন পাতা রহিল।
এসো ভাই হিন্দু! এসো ভাই মুসলমান! তোমার আমার উপর অনেল দুঃখ-ক্লেশ, অনেক ব্যথা-বেদনার ঝড় বহিয়া গিয়াছে; আমাদের এ বাঞ্ছিত মিলন বড়ো দুঃখের, বড়ো কষ্টের ভাই! খোদা যখন আমাদের জাগাইয়াছেন, তখন আর যেন আমরা না ঘুমাই। যদি এতটুকু ঘুমের খোমার আসে, তবে যেন এই ডায়ারকে স্মরণ করিয়া আবার আমরা হুংকার দিয়া খাড়া হইতে পারি, ডায়ার-স্মৃতিস্তম্ভের ওই আকাশের মর্মভেদী চূড়া দেখিয়া যেন মনুষ্যত্বের শক্তির সাড়া আমাদের মাঝে গর্জন করিয়া উঠে। আমাদের এ-মিলন যদি মিথ্যা হয়, তবে যেন আমাদিগকে সচেতন করিতে যুগে-যুগে এই ডায়ারের বজ্র বেদনার আবির্ভাব হয়। – আমাদের প্রীতি-বন্ধন অক্ষয় হোক। আমাদের এ-মহামিলন চিরন্তন হোক। আমরা আজ সব সংকীর্ণতা, অতীতের সকলদুঃখ-ক্লেশ ভুলিয়া ভাই-এর কোল বাড়াইয়া দিই। এসো ভাই, আর একবার হাত ধরাধরি করিয়া এই খোলা আকাশের মুক্ত মাঠে দাঁড়াই।
ধর্মঘট
দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘যে এলো চষে সে রইল বসে, নাড়া-কাটাকে ভাত দাও এক থালা কষে।’ হূলের দংশন-জ্বালা যথেষ্ট থাকলেও কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। স্বয়ং ‘নাড়া-কাটা’ প্রভুরাও এ-কথাটা ভালো করিয়াই বুঝেন, কিন্তু বুঝিয়াও যে না বুঝিবার ভান করেন বা প্রতিকারের জন্য নিজেদের দারাজ-দস্ত সামলান না, ইহা দেখিয়া বাস্তবিকই আমাদের মনুষ্যত্বে, বিবেক আঘাত লাগে এবং তাহারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-পতাকা তুলিলেই হইল ‘ধর্মঘট’। চাষি সমস্ত বৎসর হাড়-ভাঙা মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়াও দু-বেলা পেট ভরিয়া মাড়ভাত খাইতে পায় না, হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা তেনা বা নেঙট ছাড়া তাহার আর ভালো কাপড় পিরান পরা সারা-জীবনেও ঘুটিয়া উঠে না, ছেলেমেয়ের সাধ-আরমান মিটাইতে পায় না, অথচ তাহারই ধান-চাল লইয়া মহাজনরা পায়ের উপর পা দিয়া বারোমাস তেত্রিশ পার্বণ করিয়া নওয়াবি চালে দিন কাটাইয়া দেন। কয়লার খনির কুলিদিগকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, তাহাদের কেহ ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরের বেশি বাঁচে না; তাহারা দিবারাত্রি খনির নীচে পাতালপুরীতে আলো-বাতাস হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়া কয়লার গাদায় কেরোসিনের ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করিয়া শরীর মাটি করিয়া ফেলে। কোম্পানি তো তাহাদেরই দৌলতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিতেছেন, কিন্তু এ-হতভাগ্যদের স্বাস্থ্য, আহার প্রভৃতির দিকে ভুলিয়াও চাইবেন না। এই কুলিদিগের চেহারার দিকে তাকাইয়া কেহ কখনও চিনিতে পারিবেন না যে, ইহারা মানুষ কী প্রেত-লোক-ফেরতা বীভৎস নর-কঙ্কাল। দোষ কাহাদের? কর্তাদের মতে দোষ অবশ্য এই হতভাগাদেরই। কারণ পেট বড়ো ‘মুদ্দই’ এবং পেটের জন্যই ইহারা এমন করিয়া আত্মহত্যা করে।