আমাদের সব কথাই ভুয়ো – কর্তাদের নিমক-হালাল ছেলেগুলির কাছে। এই সেদিন মি. শাস্ত্রী একটা সোজা কথা লাট-দরবারে পেশ করিয়াছিলেন যে, লোকগুলোকে মারিবার সময় একটু বুঝিয়া-সুঝিয়া মারিও। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনি! বলা বাহুল্য, তাঁহার এ আরজি বাতিল ও না-মঞ্জুর হইয়া গেল! কালা আদমিকে মারিবে, তাহার আবার বুঝিয়া-সুঝিয়া কী? ইচ্ছা হইল, না – বাস, চালাও গুলি! মি. শাস্ত্রী সাতটি কথা পেশ করিয়াছিলেন এবং তাহার যে-কোনোটি সম্বন্ধে সরকারের অতি বড়া নিমক-হালালেরও কোনো কিছু বলিবার ছিল না। অন্তত আমরা তাহাই মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু ‘লোকদিগকে আগে সাবধান করিয়া দিয়া তবে গুলি ছুঁড়িবে’ – উপদেশটি ব্যতীত আর প্রায় সব কটিই নাকচ হইয়া গিয়াছে। মি. শাস্ত্রীর পাণ্ডুলিপিতে মোটামুটি এই কথা কটি ছিল :- প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হইতে লিখিত হুকুম লইতে হইবে। ম্যাজিস্ট্রেট না থাকিলে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হুকুম দিবেন, কিন্তু সকল দায়িত্ব তাঁহার এবং তাঁহাকে প্রমাণ করিতে হইবে যে, গুলি না চালাইলে বহু প্রাণহানি ও ক্ষতি হইত ইত্যাদি। আরো কয়েকটি এই রকম সহজ কথা। কিন্তু কালা আদমি মারিতে এত সব বাঁধাবাঁধি নিয়ম-কানুন! বাপ! বলে কী? অতএব মি. শাস্ত্রীর কথা এক ফুঁয়ে উড়িয়া গেল!
আর শুধু এ সাদাকেই দোষ দেওয়া বৃথা। দোষ আমাদেরই। কিন্তু সেসব বলিতে গেলে সাদা দাদারা ভয়ানক রকমের চটিতং হইয়া যাইবেন এবং ক্রমান্বয়ে আমাদের মুখ বন্ধ, (হাত বন্ধ তো আছেই।) পা বন্ধ – শেষকালে কাঁচা মুণ্ডটাও খণ্ড-বিখণ্ড করিয়া ফেলিবেন! ‘হক কথায় আহাম্মক রুষ্ট’ – তাই আমাদের অতি সোজা কথাটাও আইন বাঁচাইয়া বাঁকা-টেরা করিয়া বলিতে হয়। আজও সাদাদের এই গুলি মারা লইয়া কিছু বলিবার দরকার নাই। তবে, আমাদের ক্রন্দন ব্যর্থ হইতেছে না। এই যে মানুষের ব্যথিত মনের অভিশাপ, ইহা অন্তরে অন্তরে তোমাদিগকে পিষিয়া মারিতেছে। তোমাদের বিবেককে, মনুষ্যত্বকে বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতেছে। এই গুলির সমস্ত গুলিই তোমাদেরই হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়া তোমাদিগকে পচাইয়া মারিবে। আমরা জাগিতেছি – আমরা বাঁচিতেছি, – তোমরা মরিতেছ, তোমরাই ধ্বংসের পথে চলিয়াছ!
গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!
স্বাধীনতা হারাইয়া আমরা যখন আত্মশক্তিতে অবিশ্বাসী হইয়া পড়িলাম এবং আকাশমুখো হইয়া কোন্ অজানা পাষাণ-দেবতাকে লক্ষ করিয়া কেবলই কান্না জুড়িয়া দিলাম, তখন কবির কণ্ঠে আশার বাণী দৈব-বাণীর মতোই দিকে দিকে বিঘোষিত হইল, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’!’ বাস্তবিক আজ আমরা অধীন হইয়াছি বলিয়া চিরকালই যে অধীন হইয়া থাকিব, এরূপ কোনো কথা নাই। কাহাকেও কেহ কখনও চিরদিন অধীন করিয়া রাখিতে পারে নাই, কারণ ইহা প্রকৃতির নিয়ম-বিরুদ্ধ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া কেহ কখনও জয়ী হইতে পারে না। আজ যাহারা স্বাধীন হইয়া নিজের অধীনতার কথা ভুলিয়া অন্যকেও আবার অধীনতার জাঁতায় পিষ্ট করিতেছে, তাহারাও চিরকাল স্বাধীন ছিল না। শক্তি লাভ করিয়া যাহারা শক্তির এমন অপব্যবহার করিতেছে, কে জানে প্রকৃতি তাহাদের এই অপরাধের পরিণাম কত নির্মম হইয়া লিখিয়া রাখিয়াছে! ‘এয়সা দিন নেহি রহেগা’, চিরদিন কারুর সমান যায় না। আজ যে কপর্দকহীন ফকির, কাল তাহার পক্ষে বাদশাহ্ হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়। অত্যাচারীকে অত্যাচারের প্রতিফল ভোগ করিতেই হইবে। আজ আমি যাহার উপর প্রভুত্ব করিয়া তাহার প্রকৃতি-দত্ত স্বাধীনতা, মনুষ্যত্ব ও সম্মানকে হনন করিতেছি, কাল যে সে-ই আমারই মাথায় পদাঘাত করিবে না, তাহা কে বলিতে পারে? শক্তি সম্পদের ন্যায্য ব্যবহারেই বৃদ্ধি, অন্যায় অপচয়ে তাহার লয়।
অন্যকে কষ্ট দিয়ে তাহার ‘আহা-দিল’ নিতে নাই, বেদনাতুরের আন্তরিক প্রার্থনায় আল্লার আরশ টলিয়া যায়। শক্তির অপব্যবহারের জন্য রোম-সাম্রাজ্য গেল, জার্মানির মতো মহাশক্তিরও পরাজয় হইল। কত উত্থান, কত পতন এই ভারত দেখিয়াছে, দেখিতেছে এবং দেখিবে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিবেক সর্বদাই মানবের পশুশক্তিকে সতর্ক করিতেছে। বিবেকের ক্ষমতা অসীম। যাহারা পশুশক্তির ব্যবহার করিয়া বাহিরে এত দুর্বার দুর্জয়, অন্তরে তাহারা বিবেকের দংশনে তেমনই ক্ষত-বিক্ষত, অতি দীন। তাহারা তাহাদের অন্তরের নীচতায় নিজেই মরিয়া যাইতেছে, শুধু লোক-লজ্জায় তাহাকে দাম্ভিকতার মুখোশ পরাইয়া রাখিয়াছে। সিংহের চামড়ার মধ্য হইতে লুকানো গর্দভ-মূর্তি বাহির হইয়া পড়িবেই। নীল শৃগালের ধূর্তামি বেশি দিন টিকিবে না। তাই বলিতেছিলাম, বাহিরের স্বাধীনতা গিয়াছে বলিয়া অন্তরের স্বাধীনতাকেও আমরা যেন বিসর্জন না দিই। আজ যখন সমস্ত বিশ্ব মুক্তির জন্য, শৃঙ্খল ছিঁড়িবার জন্য উন্মাদের মতো সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিতেছে, স্বাধীনতা-যজ্ঞের হোমানলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা দলে দলে আসিয়া নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়াইয়া দিতেছে, তাহাদের মুখে শুধু এক বুলি, ‘মুক্তি-মুক্তি-মুক্তি’। হস্তে তাহাদের মুক্তির নিশান – মুখে তাহাদের মুক্তির বিষাণ, শিয়রে তাহাদের মুক্তির তৃপ্তি-ভরা মহা-গৌরবময় মৃত্যু। – তখনও মুক্তির সেই যুগান্তরের নবযুগেও, আমরা কিনা পলে পলে দাসত্বের, মনুষ্যত্বহীন আত্মসম্মানশূন্য ঘৃণ্য কাপুরুষের মতো অধোদিকেই গড়াইয়া চলিতেছি! এতদূর নীচ হইয়া গিয়াছি আমরা যে, কেহ এই কথা বলিলে উল্টো আবার কোমর বাঁধিয়া তাহার সঙ্গে তর্ক জুড়িয়া দিই। আমাদের এই তর্কের সবচেয়ে সাধারণ সূত্র হইতেছে, দাসত্ব – গোলামি ছাড়িয়া দিলে খাইব কী করিয়া? কী নীচ প্রশ্ন! যেন আমাদের শুধু কুকুর-বিড়ালের মতো উদর-পূর্তির জন্যই জন্ম! এমন নীচ অন্তঃকরণ লইয়া যাহারা বেহায়ার মতো বেহুদা তর্ক করিতে আসে, তাহাদের উপর খোদার বজ্র কেন যে ভাঙিয়া পড়ে না, তাহা বলিতে পারি না! আজ সারা বিশ্ব যখন ও-রকম মরার মতো বাঁচিয়া থাকার চেয়ে মরিয়া মুক্তিলাভের জন্য প্রাণ লইয়া ছিনিমিনি খেলিতেছে, তখনও আমাদের এইরকম হৃদয়হীনতার, গোলামি মনের পরিচয় দিতে এতটুকু লজ্জা হয় না! বড়োই দুঃখে তাই বলিতে হয়, ‘এ অভাগা দেশের বুকে বজ্র হানো প্রভু, যদ্দিনে না ভাঙছে মোহ-ভার।’ আমাদের এই মোহ-ভার ভাঙিবে কে? এ-শৃঙ্খল মোচন করিবে কে? আছে, উত্তর আছে, এবং তাহা, ‘আমরাই!’ নির্বোধ মেষযূথের মতো এক স্থানে জড়ো হইয়া শুধু মাথাটা লুকাইয়া থাকিলে নেকড়ে বাঘের হিংস্র আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইব না, তাহা হইলে আমাদের ওই নেকড়ে বাঘের মতো করিয়া কান ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া হত্যা করিবে।