তিনি যদি এমনই করিয়া প্রাণ খুলিয়া ইহাদের সহিত না মিশিতেন, ইহাদের সুখ-দুঃখের এমন করিয়া ভাগী না হইতেন, ইহাদিগকে যদি নিজের বুকের রক্ত দিয়া, তাহারা খাইতে পাইল না বলিয়া নিজেও তাহাদের সঙ্গে উপবাস করিয়া ইহাদিগকে নিতান্ত আপনার করিয়া না তুলিতেন, তাহা হইলে আজ তাঁহাকে কে মানিত? কে তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিত? কে তাঁহার একটি ইঙ্গিতে এমন করিয়া বুক বাড়াইয়া মরিতে পারিত? তাঁহার আভিজাত্য-গৌরব নাই, পদ-গৌরবের অহংকার নাই, অনায়াসে প্রাণের মুক্ত উদারতা লইয়া তোমাদের ঘৃণ্য এই ‘ছোটোলোক’-কে বক্ষে ধরিয়া ভাই বলিয়া ডাকিয়াছেন, – সে-আহ্বানে জাতিভেদ নাই, ধর্মভেদ নাই, সমাজ ভেদ নাই, – সে যে ডাকার মতো ডাক, – তাই নিখিল ভারতবাসী, এই উপেক্ষিত হতভাগারা তাঁহার দিকে এত হাহা করিয়া ব্যগ্রবাহু মেলিয়া ছুটিয়াছে। হায়, তাহাদের যে আর কেহ কখনও এমন করিয়া এত বুকভরা স্নেহ দিয়া আহ্বান করেন নাই! এ মহা-আহ্বানে কী তাহারা সাড়া না দিয়া পারে? যদি পার, এমনি করিয়া ডাকো, এমনি করিয়া এই উপেক্ষিত শক্তির বোধন করো – দেখিবে ইহারাই দেশে যুগান্তর আনিবে, অসাধ্য সাধন করিবে। ইহাদিগকে উপেক্ষা করিবার, মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার তোমার কী অধিকার আছে? ইহা তো আত্মার ধর্ম নয়। তাহার আত্মা তোমার আত্মার মতোই ভাস্বর, এর একই মহা-আত্মার অংশ। তোমার জন্মগত অধিকারটাই কী এত বড়ো? তুমি যদি এই চণ্ডাল বংশে জন্মগ্রহণ করিতে, তাহা হইলে তোমার মতো ভদ্রলোকদের দেওয়া এই সব হতাদর উপেক্ষার আঘাত, বেদনার নির্মমতা একবার কল্পনা করিয়া দেখো দেখি, – ভাবিতে তোমার আত্মা কি শিহরিয়া উঠিবে না?
আমরা ভারতবাসীরাই শুধু আত্মার এত অবমাননা করিতে সাহস করি, আর তাই আমাদের শোচনীয় অধঃপতন, – তাই বিশ্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার আমাদের স্থান নাই। এই আত্মার অপমানে, যে সেই অনাদি অনন্ত মহা-আত্মারই অপমান করা হয়। ভয়ে অঙ্গ শিহরিয়া উঠে না কি? খোদার সৃষ্ট – তাঁহার আনন্দের বিকাশস্বরূপ এই মানুষকে ঘৃণা করিবার অধিকার তোমায় কে দিয়াছে? তোমাকেই বা বড়ো হইবার অধিকার কে দিয়াছে, তুমি কীসের জন্য ভদ্র বলিয়া মনে কর? এসব যে তোমারই নিজের সৃষ্টি, – খোদার উপর খোদকারি। এ মহা-অপরাধের মহাশাস্তি হইতে তোমার রক্ষা নাই, – রক্ষা নাই। মানুষের প্রতি এই যে হিংসা, দ্বেষ, তোমার দেশের, গাঁয়ের প্রতিবেশী ভাইদের প্রতি এই যে অকারণ ঘৃণা, আক্রোশ, ইহাই তোমার মূর্খের বর্ণ কালো করিয়া দিয়াছে – তোমার চেহারায় কালি ছড়াইয়া দিয়াছে। মরিতে তো বসিয়াছ, – যদি এখনও এই মৃত হতভাগ্যদের হাত ধরিয়া না উঠিয়া একা উঠিতে যাও, তবে আরও মার খাইয়া মরিবে। কীসের পতিত ইহারা? ইহাদের প্রাণ যত উন্মুক্ত – ইহাদের অন্তর যেমন সরল, – তুমি কি সেরকম হইতে পার? হইতে পারে অশিক্ষিত সে, কিন্তু ইহার প্রাণ তোমার চেয়ে অনেক বড়ো, সে প্রাণে বিরাট বিপুল শক্তি-সিংহ সুপ্ত হইয়া রহিয়াছে, – যদি পার সেই শক্তিকে জাগাও।
আমাদের এই পতিত, চণ্ডাল, ছোটোলোক ভাইদের বুকে করিয়া তাহাদিগকে আপন করিয়া লইতে, তাহাদেরই মতো দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তোমারও প্রাণ সংযোগ করিয়া উচ্চশিরে ভারতের বুকে আসিয়া দাঁড়াও, দেখিবে বিশ্ব তোমাকে নমস্কার করিবে। এসো, আমাদের উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরিয়া আজ ভারত-বেদির সামনে দাঁড়াইয়া বোধন-বাঁশিতে সুর দিই –
‘কীসে দুঃখ, কীসের দৈন্য,
কীসের লজ্জা, কীসের ক্লেশ!’
কালা আদমিকে গুলি মারা
একটা কুকুরকে গুলি মারিবার সময়েও এক আধটু ভয় হয়, যদিই কুকুরটা আসিয়া কোনো গতিকে গাঁক করিয়া কামড়াইয়া দেয়! কিন্তু আমাদের এই কালা আদমিকে গুলি করিবার সময় সাদা বাবাজিদের সে ভয় আদৌ পাইতে হয় না। কেন না তাহারা জানে যে, আমরা পশুর চেয়েও অধম। একবার এক সাহেবের গুলির চোটে আমাদের স্বগোত্র এক কালা আদমি মারা যায়, তাহাতে সাহেব জিজ্ঞেস করেন ‘কৌন্ মারা গিয়া?’ একজন আসিয়া বলিল, ‘এক দেহাতি আদমি হুজুর!’ সাহেব দিব্যি পা ফাঁক করিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘ওঃ, হাম সমঝা থা, কোই আডমি!’ অর্থাৎ ওই গ্রাম্য বেচারা সাহেবের বিড়াল-চোখে মানুষই নয়। মনুষ্যকে এত বড়ো ঘৃণা আর কেহ কোথাও প্রদর্শন করিতে পারে কি-না, জানি না। ইহার পরাকাষ্ঠা দেখানো হইয়াছে জালিয়ানওয়ালাবাগে ও অন্যান্য স্থানে। আবার এই সেদিনও তাহারই পুনরভিনয় হইল কালিকটে। নিরস্ত্র জনসংঘ – যাহাদের হাতে একটু বে-মানানসই বংশখণ্ড দেখিলেও অস্ত্র-আইনের কব্জায় আসে, তাহাদিগের প্রতি গুলি চালাইয়া কী ঘৃণ্য কাপুরষতাই না দেখাইতেছে এই গোরার দল! কিন্তু এসব বর্বরতার জন্য দায়ী কে?
খোদ কর্তাই নন কি? ‘মাকড় ধরলে ধোকড় হয়’ নীতিকে কী গবর্নমেন্টই প্রশ্রয় দিতেছে না? এই সব মনুষ্যত্ব-বিবর্জিত খুন-খারাবি যে যত করিতে পারিবে, তার তত পদোন্নতি, তত চাপরাশ বৃদ্ধি সরকারের দরবারে। অথচ সাধারণকে বলা যাইতেছে, দোষ আমাদের নয় ইত্যাদি। যদি তাই হয়, তবে এই অবাধ হত্যা – নিরস্ত্র নির্দোষ জনসংঘের উপর হাসিতে খেলিতে গুলি চালানো ব্যাপারটাকে নিবারণ করিবার জন্য চেষ্টা করিলে গবর্নমেন্ট তাহাতে বাধা দেয় কেন? বা সাধারণের কথায় কর্ণপাতই বা করে না কেন? এই একগুঁয়েমির জন্যই তো আজ এমন করিয়া হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্যন্ত একটা বিপুল কম্পন শুরু হইয়া গিয়াছে। এই ভূমিকম্পকে চাপা দিয়া রাখিবার ক্ষমতা আর স্বেচ্ছাতন্ত্রের নাই। তেত্রিশ কোটি মানুষকে অবহেলা করিয়া, ঘৃণা করিয়া তিন শত লোক তাহাদিগকে চাবুক মারিবে এবং তাহারা তাহা সহিয়া থাকিবে, সে দিন আর নাই। নেহাত অসহ্য না হইয়া পড়িলে মানুষ বিদ্রোহী হয় না। শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ যে কত কষ্ট, কত যন্ত্রণায় তবে অশান্তকে বরণ করিয়া লয়, তাহা ভুক্তভোগী ব্যতীত কেহ বুঝিবে না; এখন মনুষ্যত্ব না জাগুক, অন্তত এই পশুত্বটুকুও আমাদের মনে জাগিয়াছে যে, মনুষ্যত্বের অপমান সহার মতো পাপ আর নাই। এ শিক্ষাও আমাদের ঠেকিয়া শিখিতে হইতেছে।