আর তাহা ছাড়া দেশের লোকের বর্তমান দাবি-দাওয়া পূর্ণ করাও তাঁহার ক্ষমতার বাহিরে। একটা প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে আমরা যতটা স্বাধীন মনে করি, আসলে তিনি ততটা স্বাধীন নন। তিনিও প্রকারান্তরে শুধু তাঁহার উপরওয়ালারই হুকুম তামিল করেন, বলা যাইতে পারে। কাজেই বুঝিয়া হউক, না বুঝিয়া হউক, দেশের লোকে তাঁহার উপর বিষম চটিয়া উঠিতেছে এবং নানান রকমের টীকাটিপ্পনীও কাটিতেছে! এ হুলের বিষজ্বালা তাঁহাকে অতি কষ্টে নীরবেই সহ্য করিতে হইতেছে, কেননা, আমরা ছেলেবেলার পদ্যপাঠে পড়িয়াছি, ‘অসহ্য জ্ঞাতির বাক্য সহ্য নাহি হয়, সাপের মাথায় যেন ব্যাঙে প্রহারয়!’ কিন্তু ইহাতে তাঁহার দুঃখ-কষ্ট অনুভব করা উচিত নয়। কেননা, সর্বপ্রথম দেশীয় শাসনকর্তা বলিয়া দেশের লোক তাঁহার নিকট অনেক কিছু আশা করিয়াছিল। কিন্তু কর্মের বা গ্রহের ফেরে সমস্ত ওলট-পালট হইয়া গেল। এখন তিনি দেশের লোককে সন্তুষ্ট করিতে পারেন না এবং খুব কষিয়া কড়া শাসন চালাইয়া তাহাদিগের মুখ বন্ধ বা তাহাদের দোরস্ত করিতেও পারেন না। কেননা, বেশি জোরজবরদস্তি করিলে দেশের লোক আরও বেশি খেপিয়া উঠিবে। মানুষের চামড়া কিছু গণ্ডারের চামড়া নয়, অতএব দেশ-ভাই- এর ও আঘাত হয়তো তাঁহার গায়ে দারুণ বাজিবে। আজ যদি বিহারের শাসনকর্তা কোনো ইংরেজ হইতেন, তাহা হইলে হয়তো দেশবাসী বিহার লইয়া এত বেশি আলোচনা করিত না। অথবা তিনি যে প্রদেশেরই লাট হইতেন, সেই প্রদেশের শাসন ইত্যাদি ব্যাপারে দেশের লোক বেশি করিয়া চোখ রাখিত। দেশীয় শাসনকর্তার নিকট দেশ-ভাই-এর একটু বেশি অধিকারের দাবি বাড়াবাড়ি বোধ হইলেও অন্তত অন্যায় নয়।
এ তো গেল এদিককার কথা। অন্য পিঠ – অর্থাৎ তাঁহার অধীন ইংরেজ শাসনকর্তারা যত বেশি প্রভুভক্তি ও কর্মকুশলতাই দেখান না কেন, এদেশি ‘নেটিভ’ শাসনকর্তার অধীন হইয়া থাকিতে তাঁহাদের মর্মস্থলে বেশ একটু বাজে এবং হিংসাও হয়। ইউরোপীয় গবর্নর থাকিলে তাঁহারা (বিশেষ করিয়া বিহার প্রদেশ বলিয়া) অনায়াসে দেশি লোককে নেটিভ, নিগার ইত্যাদি বলিয়া এ-গোলমালে খুব একচোট গালি-গালাজ করিয়া গায়ের ঝাল আর রসনার চুলকানি মিটাইতেন। কিন্তু এখন আর ও রকম গালি-গালাজ দিতে পারিবেন না, কেননা তাহা হইলে প্রকারান্তরে লর্ড সিংহকেই গাল দেওয়া হইবে। অথচ তাঁহারা এটুকুও বুঝিয়াছেন যে, ইউরোপীয় শাসনকর্তার আমল অপেক্ষা তাঁহারা অধিকতর স্বাধীনভাবে এখন দেশকে শাসাইতে পারিবেন। কেননা, যতই হোক দেশীয় গবর্ণর তো! তিনি কিছুতেই ইহাদের এই নীতিকে একদম বদ্ধ করিয়া দিতে পারিবেন না। কেননা তখন এই ইউরোপীয় ‘ডিমিনিউটিভ’ শাসনকর্তারা দল বাঁধিয়া ইহার বিরুদ্ধে হই রই মার লাগাইয়া উপরওয়ালার কানে ঝালাপালা লাগাইয়া দিবে। এই সব এবং এই রকম আরও নানান গতিকে লর্ড সিংহ বাহাদুর চুপ করিয়া ভাবিতেছেন, ‘শ্যাম রাখি কী কুল রাখি!’ তিনি এখন প্রাণপণে দু-নৌকায় পা দিয়া আছেন বলিলেই হয়। কেননা, এখন তিনি হতাশ হইয়া বলিতেছেন, প্রকারান্তরে আমি গান্ধিজিকে সমর্থন করিতেছি। তাঁহার মতো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই আমার কাজ।
কিন্তু অবস্থা ক্রমেই যেরকম বিগড়াইয়া যাইতেছে, তাহাতে তাঁহার আর এ ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ ভাব চলিবে না।
আমরা তাঁহাকে আক্রমণ করিতেছি না, বরং তাঁহার এ ত্রিশঙ্কুর মতো অবস্থা দেখিয়া সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি। দোষ তাঁহারও নয়, আমাদেরও নয়, এ দোষ বুরোক্রাসির বা স্বেচ্ছাতন্ত্রের।
যতক্ষণ দেশের আদত শাসনকর্তা স্বেচ্ছাতান্ত্রিক, যতক্ষণ দেশ পরাধীন থাকে, ততক্ষণ দেশীয় ছোটোখাটো শাসনকর্তারা কিছুতেই লোককে সন্তুষ্ট করিতে পারেন না। আজ যদি লর্ড সিংহ ভারতের বড়োলাটও হন, তাহা হইলে তিনি দেশের জন্য তেমন কিছু করিতে পারিবেন না। তাঁহাকে অধিকাংশ সময়েই তাঁহার বিবেক-বিরুদ্ধ কার্য করিতে হইবে। দেশীয় লোক যত বড়ো পদই পান, তবু তিনি যে দেশীয় বা ‘নেটিভ’ একথা ইংরেজ কর্তারাও ভুলিবেন না, আর তিনি নিজেও ভুলিতে পারিবেন না। আজ যদি লর্ড সিংহ একটু দেশের লোকের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন, তাহা হইলে সকলে বুঝিতে পারিবেন, ইংরেজ মন্ত্রীর দল কীরকম আপিস-তাপিস করিয়া উঠেন। তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইবেন – ‘এক যাত্রায় পৃথক ফল!’ এ দোষ কাহারও নয় ভাই – দোষ আমাদের এই কালো চামড়ার!
সত্য-শিক্ষা
তোরণে তোরণে ভৈরব-বিষাণ বাজিয়া উঠিয়াছে – ‘জাগো পুরবাসী!’ দিকে দিকে মঙ্গল শঙ্খে তাহারই প্রতিধ্বনি উঠিয়া আমাদের রক্তে রক্তে ছায়ানটের নৃত্যরাগ তুলিয়াছে। এই যে আমাদের জীবনের উন্মাদ নট-নৃত্য, এ শুধু বিশ্বের কল্যাণ-মুক্তিতে নয়, এই মুক্তি-যুগে আমরাও আমাদের ভাবী সিংহ-দ্বারের পূর্বতোরণে নহবতের বাঁশি শুনিয়াছি বলিয়া। তাই আর আমরা শুধু দার্শনিকের ভিতরের যুক্তিতে সন্তুষ্ট নই, এখন চাই বাইরের ব্যবহারিক জীবনে মুক্তি। এই ‘আজাদি’র সাড়া না পাইলে আমাদের জীবনে আজ এমন তরুণের উচ্ছৃঙ্খলতা, সবুজের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দিত না। রক্তনিশান লইয়া আজ আমাদের নূতন করিয়া যাত্রা শুরু; এই শোভাযাত্রার দুর্মদ অগ্রযাত্রী আমাদের যে কিশোর আর তরুণের দল, সর্বাগ্রে তাহাদিগেরই অন্তরে বাহিরে ‘আজাদি’র নেশা জমাইয়া তুলিতে হইবে। কারণ, ইহাদের মৃত্যুবিদ্রোহে অলস ভীরু জীবন পথযাত্রীর বুকে সাহস সঞ্চর হইবে। আমরা কিন্তু আমাদের এই উন্মুক্ত উদার প্রাণগুলির চারিপাশে নিত্য বন্ধন-বাধা সৃজন করিয়া তাহাদিগের উচ্ছল গতিকে অচল করিতেছি। তাই বিজাতির বিভিন্ন শৃঙ্খল কাটিয়া জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কথা শুনিয়া আমরা আজ এত আনন্দধ্বনি করিতেছি। যাহাতে এই জাগরণ-যুগের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ এই জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাহিরে না হইয়া অন্তরে হয়, সেই জন্যই আমরা এ-সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিতেছি। আজ ইংরাজের সহযোগিতা বর্জন করিতেছি বলিয়াই যে রাগের মাথায় যেন-তেন-প্রকারেণ দুই-একটা ঠাটকবাজিগোছ জাতীয় স্কুল-কলেজ দাঁড় করাইয়া সরিয়া পড়িতে হইবে, তাহা নয়; অসহযোগিতার মৌসুম না আসিলেও জাতীয়তার দিক দিয়া আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। বিজাতীয় অনুকরণে আমরা ক্রমেই আমাদের জাতীয় বিশেষত্ব হারাইয়া ফেলিতেছি। অধিকাংশ স্থলেই আমাদের এই অন্ধ অনুকরণ হাস্যাস্পদ ‘হনুকরণে’ পরিণত হইয়া পড়িয়াছে। পরের সমস্ত ভালো-মন্দকে ভালো বলিয়া মানিয়া লওয়ায়, আত্মা, নিজের শক্তি ও জাতীয় সত্যকে নেহাতই খর্বই করা হয়। নিজের শক্তি, স্বজাতির বিশেষত্ব হারানো মনুষ্যত্বের মস্ত অবমাননা। স্বদেশের মাঝেই বিশ্বকে পাইতে হইবে, সীমার মধ্যেই অসীমের সুর বাজাইতে হইবে। তাই, এই সহযোগিতা বর্জনের দিনে ‘খোশখবর কা ঝুটা ভি আচ্ছা’ স্বরূপ আমাদের দীর্ঘ পরিপোষিত আশার কার্যে পরিণত হইবার কথা শুনিয়া গভীর তৃপ্তি অনুভব করিতেছি।