প্রত্যেক কয়লার চাপ ও প্রত্যেকটি দেশলাই যাহা জ্বালানো হয়, তাহা প্রত্যহ আমাদের দরকারি অম্লজান বাষ্প নিঃশেষ করিতেছে।
একজন বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক সম্প্রতি ঘোষণা করিয়াছেন যে, জগতের অম্লজান ক্রমশই নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছে, এবং বাতাসও সেইজন্য ক্রমেই কলুষিত হইয়া উঠিতেছে, সুতরাং সেদিন আগতপ্রায় – যেদিন পৃথিবীর সমস্ত কিছু কার্বনিক অ্যাসিডময় যুগের জীবে পরিণত হইয়া যাইবে।
মানুষ ক্রমেই ক্ষুদ্র ও দুর্বল হইতে হইতে শেষে লিলিপুটিয়ানদের মতো হইয়া পড়িবে, তার পর একবারেই নেস্তানাবুদ! তারপর আদির মতোই অস্ত! অর্থাৎ প্রথমে যেমন মৎস্য আর সরীসৃপ জাতিই ছিল, পরেও তেমনই য়্যা প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মহা-মৎস্য আর মহা-সরীসৃপ অবতারগণ বহাল খোশ-তবিয়তে বিরাজ করিবেন।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের খুব সরু লম্বা ঘৃণ্য সরীসৃপ জাতিও – যেমন, কেঁচো সাপ ইত্যাদি – প্রচুর পরিণামে আবার আমাদের ঢিপেয় রাজত্ব করিবে।
যদি মানবজাতি বর্তমানের এই অনিষ্টকারী কয়লার মহা-খরচা ছাড়িয়া দেয় (শুধু কয়লা জ্বালানোর জন্যই বৎসরে ১৬০০ মিলিয়ন টন অম্লজান বাষ্প নষ্ট হইতেছে।) এবং তৎপরিবর্তে ইলেকট্রিক দিয়া কয়লার কাজ চালাইয়া লয়, তাহা হইলে আমাদিগকে আবার আর এক নূতন বিপদের মুখ-গহ্বরে পড়িতে হইবে! অর্থাৎ যেদিকেই যাও, নিশ্চয়ই মরিতে হইবে। জলে কুমির, ড্যাঙায় বাঘ!
আগে হইতে আবহাওয়ার ক্রম-পরিবর্তন পরিলক্ষিত হইতেছে। বজ্রাঘাত – বিশেষ করিয়া শীতকালে বজ্রপতন – ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে, আর ইহার একদম সোজা কারণ রহিয়াছে যে, পৃথিবীর আর বাতাসের ইলেকট্রিসিটি ঠোকাঠুকি দরুনই এই বজ্র উৎপাতের সৃষ্টি! তাহা হইলে কঃ পন্থা? সেই জন্যই বুঝি পান্নাময়ী আগে হইতেই গাহিয়া রাখিয়াছে, ‘মরিব মরিব সখি, নিশ্চয়ই মরিব!!’
আচ্ছা ধরুন, যদি বায়বীয় ইলেকট্রিসিটির উপরে বর্তমান অপেক্ষা শত বা সহস্র গুণ ভার চাপানো হয় তাহা হইলে আর কি বসন্তে ফুল ফুটিবে – কচি পাতা গজাইবে? আর কি তবে বর্ষার ব্যাকুল বরিষন পৃথিবীর বক্ষ সিক্ত করিবে? না, গো না! তার বদলে বজ্র-পতনই হইবে আমাদের পৃথিবীতে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রোজ শত শত বজ্রপাতে পৃথিবী ছিন্না-ভিন্না হইয়া যাইবে। একজন ধুরন্ধর উল্কাতত্ত্ববিৎ বৈজ্ঞানিক বলিতেছেন, হাঁ হাঁ, তাহাই হইবে অবশেষে! কী ভয়ানক! আমাদের এখন উচিত যে, আমরা সবাই মিলিয়া প্রাণপণে চক্ষু বুজিয়া বিশ্বাস করি, ও-ভদ্রলোকের কথা মিথ্যা এবং তিনি ভুল বুঝিয়াছেন। ওই যে আমাদের আলোকদাতা সবিতা সুয্যিমামা – উনি শুধু যে আলো আর উষ্ণতারই সৃষ্টি করেন তা নয়, তিনি ইলেকট্রিক শক্তিরও জনক। আর এই আমাদের একমাত্র মামা যিনি প্রকৃতির এই প্রহেলিকাময় অজানা শক্তির সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য সব দিক সমঝাইয়া চলিবেন! মামা জীবতু!
বর্তমান সুয্যিমামার ক্ষমতা এত উগ্র প্রচণ্ড যে, যদি এঁর সমস্ত রশ্মি আর উগ্রতা শুধু আমাদের এই গরীব পৃথিবীর উপর আসিয়া পড়িত, তাহা হইলে মাত্র দেড়মিনিটের মধ্যেই ওই যে আগে মহা-মহা বরফ-পর্বতের কথা বলিয়াছি, সে সমস্তই গলিয়া টগবগ করিয়া ফুটিত। এবং আরও এগারো সেকেন্ড থাকিলে দুনিয়ার এত বড়ো সমুদ্র, সমস্ত শুকাইয়া ফাটিয়া চৌচির হইয়া হাঁ করিয়া থাকিত।
কিন্তু সুয্যিমামাও দিন দিন সংকুচিত হইয়া ছোটো হইয়া চলিয়াছেন। দৈনিক কতটুকু করিয়া যে তাঁহার বর-বপুর সংকোচন হইতেছে তাহা এখনও জানা যায় নাই। প্রফেসর বার্নস জোরের সঙ্গে বলেন যে, সুয্যিমামার এই সংকোচন বড়ো জোরেই চলিতেছে। এত জোরে যে আমরা তাহার একটি মোটামুটি ধারণাও করিতে পারি না। অতি অল্প কালের মধ্যেই সূর্যের উত্তাপের কমতি দেখিয়া বুঝিতে পারি যে, সত্যি সত্যিই সূর্য ছোটো হইয়া যাইতেছে কিনা।
এই রকম ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র হইতে হইতে যখন সুয্যিমামা পটল তুলিবেন, অর্থাৎ তাঁহার আর অস্তিত্বই থাকিবে না, তখন সে দুর্দশা হইবে পৃথিবীর, তাহার চিন্তাও মহা-ভয়াবহ! যত জল জমিয়া একেবারে পাথরের চেয়েও শক্ত হইয়া উঠিবে, কিন্তু দেখিতে হইবে খাসা – একেবারে হিরের টুকরোর মতন জ্বলজ্বলে!এই যে বাতাস যাহাকে এখন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, ইহা তখন বৃষ্টির মোটামোটা ফোঁটার মতো হইয়া ঝরিয়া পড়িবে। এইসব আবার গহ্বরে গহ্বরে জমিয়া কাচের চেয়েও স্বচ্ছ সরোবরে পরিণত হইবে, কিন্তু তাহাতে ঢেউ খেলিবে না, শুধু নির্বিকার, প্রশান্ত! কেননা তখন বাতাসই যে বহিবে না। সমস্ত পৃথিবী তখন নির্দয় শীতের প্রকোপে জমিয়া স্থির নিশ্চল হইয়া যাইবে । শুধু নীহারিকা আর অস্পষ্ট কুয়াশা!
সূর্য আস্তে আস্তে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিবে, আবার সারাদিন অমনই রক্তবর্ণ থাকিবে। ঠিক যেন আধ-নির্বাপিত একটা জ্বলন্ত গলিত লৌহপিণ্ড! দিনেই তখন সমস্ত আকাশ আরও উজ্জ্বল তারায় ভরিয়া উঠিবে! আল্লা-হু-আকবর!
লাট-প্রেমিক আলি ইমাম
হায়দ্রাবাদের নিজামের প্রধানমন্ত্রী সার সৈয়দ আলি ইমাম বিলাতে গত ১১ মার্চ রাত্রে লর্ড এবং লেডি রিডিং-এর সম্মানার্থে এক ভোজ দিয়াছিলেন। সেই ভোজসভায় বক্তৃতা দিবার সময় তিনি মি. মন্টেগুকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাইয়া বলেন, মি. মন্টেগু ভারতের কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য প্রবল প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও ভীষণ যুদ্ধ (অবশ্য বাকযুদ্ধ) করিয়াছেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ আশ্চর্য তৎপরতার সহিত গত ১৯১৪ সালের মহাবিপদের সময় ভারতীয় সৈন্যদিগকে চটপট আসরে নামাইয়া ভারতীয়দিগের ভীষণ রাজভক্তির কথা সপ্রমাণ করিয়াছেন। লর্ড রিডিং ভারতের লাটগিরি করিতে স্বীকৃত হইয়া ব্যক্তিগত স্বার্থত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন! তাঁহার এই নিঃস্বার্থ বলিদানে ভারত কৃতার্থ হইয়া যাইবে! ভারতের বর্তমানে যে সংকটাপন্ন অবস্থা, তাহাতে এই রকম একজন গুণসম্পন্ন প্রতিভান্বিত ইংরাজ রাজপুরুষের ভয়ানক দরকার ছিল। তিনি লর্ড রিডিংকে ভরসা দিয়া আরও বলেন যে, ভারতের জন্য বা সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য যাহা কিছু করিতে হইবে, তাহাতেই তিনি (না ডাকিতেই) গিয়া হাত লাগাইতে পিছ-পা নন।… লর্ড রিডিং প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘আমি সার আলি ইমামের সব নয়। (অ্যাঁ,– যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর!) যে কোনো মহাপুরুষই হউন, ত্রিশ কোটি লোকের উপর হর্তাকর্তা বিধাতা হওয়াটা তাঁহার পক্ষে বড়ো সোজা কথা নয়। পরম করুণাময় চরম প্রসন্ন না হইলে কোনো ভায়ার এ (গয়াসুরের) পাদপদ্ম লাভ হয় না। (অত্যধিক আনন্দে ‘মনে মনে’ ঈশ্বরকে নমস্কার!) মস্ত বড়ো একটা বিরাট রকমের মহাপদ-প্রাপ্তির জন্য আমি লাটের মলাটে নিজের নাম লিখাইতে রাজি হই নাই, আমাকে ওই পদের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত লোক ভাবিয়া লাট নিযুক্ত করা হইয়াছে বলিয়া আমার এই স্বার্থত্যাগ!’ লর্ড রিডিং এইখানেই না থামিয়া হুড়মুড় করিয়া আরও বলিতে থাকেন যে, তিনি যে এত বিস্তৃততর একটা স্থান ও কাজ দেখাইবার সুযোগ পাইলেন ইহার জন্য তিনি গর্বিত। এইবার তিনি দেখাইয়া দিবেন যে, তাঁহার কার্যক্ষমতা কত বেশি। এতদিন তাঁহাকে আইন অনুসারে বিচার নিষ্পত্তি করিতে হইয়াছে, কিন্তু এইবার তিনি বিবেক দিয়া বিচার করিতে পারিবেন। তাই এই ভারতত্রাতার পদমঞ্জুরি। তিনি ‘বহু আশা করিয়া’ ভারত-যাত্রা করিতেছেন যে, ভারত পৌঁছিয়াই তিনি দেশব্যাপী এমন এক জলবায়ুর সৃষ্টি করিয়া ফেলিবেন, যাহাতে গবর্নমেন্ট আর ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে পরস্পরের একটা সহানুভূতিপূর্ণ বোঝাপড়া বা লেখাপড়া হইয়া যাইবে। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে প্রজাপালন করিবেন বলিয়া তিনি মহৎ আশা করেন! আশ্চর্য কথাই কী না শুনিলাম! তাঁহার স্কন্ধে কত বড়ো দায়িত্বের জোয়াল চড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে ভাবিয়া তিনি প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় কাতর মিনতি জানাইবেন, যেন তিনি তাঁহার ওই গর্দানের জোয়ালোপযুক্ত হন!