ওরে আমার ভারতের সেরা, আগুন খেলার সোনার বাংলা! কোথায় কোন্ অগ্নিগিরির তলে তোর বুকের অগ্নি-সিন্ধু নিস্তব্ধ নিস্পন্দ হয়ে পড়ল? কোন্ অলস-করা করুণার দেবতার বাঁশির সুরে সুরে তোর উত্তাল অগ্নি-তরঙ্গ-মালা স্তব্ধ-নিথর হয়ে পড়ল? কোথায় ভীমের জন্মদাতা পবন? ফুঁ দাও, ফুঁ দাও এই নিবন্ত অগ্নিসিন্ধুতে, আবার এর তরঙ্গে তরঙ্গে নিযুত নাগ-নাগিনীর নাগ-হিন্দোলা উলসিয়া উঠুক। ওগো করুণার দেবতা, প্রেমের বিধাতা, বাঁশির রাজা! তোমরা মুক্ত বিশ্বের, তোমরা এ ঘুমন্ত দাস-অলস ভারতের নও। এই অলস জাতিকে তোমাদের সুরের অশ্রুতে আরও অলস-উতল করে তুলো না। তোমাদের সুরের কান্নায় কান্নায় এদের অলস আর্ত আত্মা আরও কাতর, আরও ঘুম-আর্দ্র হয়ে উঠল যে। এ সুর তোমাদের থামাও। আঘাত হানো, হিংসা আনো, যুদ্ধ আনো, এদেরে এবার জাগাও, কান্নাকাতর আত্মাকে আর কাঁদিয়ো না।
আমরা যে আশা করে আছি, কখন সে মহা-সেনাপতি আসবে যার ইঙ্গিতে আমাদের মতো শত কোটি সৈনিক বহ্নি-মুখ পতঙ্গের মতো তার ছত্রতলে গিয়ে ‘হাজির হাজির’ বলে হাজির হবে। হে আমার অজানা প্রলয়ংকর মহা-সেনানী, তোমায় আমি দেখি নাই, কিন্তু তোমার আদেশ আমি শুনেছি, আমি শুনেছি। আমায় যুদ্ধ-ঘোষণার যে তূর্য-বাদনের ভার দিয়েছ, সে ভার আমি মাথা পেতে নিয়েছি। এ যে তোমার হুকুম। সাধ্য কি, আমি তার অমান্য করি? হে আমার অনাগত অব্যক্ত মহাশক্তি! বাজাও, বাজাও, এমনি করে আমার কণ্ঠে তোমার প্রলয় শিঙা বাজাও! তোমার রণভেরি আমারই ক্ষীণ কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠুক। ঘরের পরের সকল মার, সকল আঘাত যেন নির্বিকার চিত্তে, হাসিমুখে সহ্য করে আমি তোমারই দেওয়া তূর্যে যুদ্ধ-ঘোষণা করতে পারি। হে আমার অপ্রকাশ মহাবিদ্রোহী, তুমিই আমায় বল দিয়ো। যেদিন তুমি আসবে সেদিন যেন তোমারই পতাকা-তলে তোমার দেওয়া তরবারি-করে, রক্ত-সৈনিক-বেশে দাঁড়াতে পারি। সেদিন কলিজার শোণিত-মাখা তরবারি তোমার পদতলে অর্ঘ্য দিয়ে তোমার রক্ত-আঁখির প্রসাদ-চাওয়ায় বঞ্চিত না হই। যখন দুশমনের বর্শাফলক আমার বুকে বিদ্ধ হয়ে আমায় সৈনিকের গৌরব-দীপ্ত মরণের অধিকারী করবে, যখন আমার রক্তহীন দেহ ধুলায় লুটিয়ে পড়বে সেদিন-তুমি বোলো প্রভু, ‘বৎস! তুমি তোমার কর্তব্য করেছ।’ মনে করি হয়তো এ তূর্য-বাদনের শক্তি আমার নাই, কিন্তু ছাড়তে তো পারি না, তোমার অব্যক্ত শক্তি, আমায় ছাড়তেও দেয় না, পিছুতেও দেয় না। সে ক্রমেই অগ্রে আরও অগ্রে ঠেলে নিয়ে যায়। আমার অসম্পূর্ণতা, আমার অপ্রকাশ, যা তোমার চোখে ক্ষমার, তা যে অন্যের চক্ষে অপরাধের, প্রভু। আমার বিদ্রোহের মাঝে যেটুকু অহংকার, শুধু সেইটুকু আমার হোক, তুমি শুধু বলো – আমার কণ্ঠে এসো বলো – ‘এ বিদ্রোহ আমার।’
ওই অহংকারের দুর্নামটুকু আমি মাথা পেতে নিতে পারি, সেই শক্তি আমায় দাও। আমার মাঝে বিদ্রোহী বেশে যখন এলে, হে আমার অনাগত মহাবিদ্রোহী বিপুল শক্তি, তখন তো বুঝিনি যে, আমায় শুধু বাইরের আঘাত, ঘরের মারটুকুর অধিকারী করে নিলে, তখন তো বুঝিনি যে, এই বিদ্রোহের প্রসাদ, এ কল্যাণ-ক্ষীরটুকু তোমার। আজ শুধু ডাকছি, আর ডাকছি, আমায় এবার তোমার যুদ্ধ-পতাকা-তলে ডেকে নাও, মরণের মাঝে ডেকে নাও। আমায় দেওয়া তোমার তূর্য-কেতন অন্য সৈনিককে দাও।
সেবার মাঝে আমায় সাড়া দিবার অধিকারী করলে না। বললে, –
‘আর্তের অশ্রুমোচন আমার নয়, আমার রণ-তূর্য। আমি প্রলয়ের, আমি প্রেমের নই। আমি রুদ্রের, আমি করুণার নই। আমি সেবার নই, আমি যুদ্ধের। আমি সেবক নই, আমি সৈনিক। আমি পূজার নই, আমি ঘৃণার। আমি অবহেলার, আমি অপমানের। আমি দেবতা নই, আমি হিংস্র, বন্য, পশু। আমি সুন্দর নই, আমি বীভৎস। আমি বুকে নিতে পারি না, আমি আঘাত করি। আমি মঙ্গলের নয়, আমি মৃত্যুর। আমি হাসির নয়, আমি অভিশাপের।’ হে আমার মাঝের তিক্ত শক্তি, রুদ্রজ্বালা, বিষ-দাহন! হে আমার যুগে যুগে নির্মম নিষ্ঠুর সৈনিক-আত্মা, তোমায় আমি যেন প্রশংসার লোভে খাটো না করি। তোমাকে দেবতা বলে প্রকাশ করবার ভণ্ডামি যেন কোনোদিন আমার মাঝে না আসে। আমি নিজে যতটুকু, ঠিক ততটুকুই যেন প্রকাশ করি। যুগে যুগে পশু-আমার, সৈনিক-আমার জয় হউক!!
তুবড়ি বাঁশির ডাক
ওই শোনো –
পুব সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী।
শূন্যে বাজায় ঘন ঘন
হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন
সাপ খেলাবার বাঁশি।
বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো বিবর থেকে ‘অগ্নি-বরণ নাগ-নাগিনি’ তোমাদের নিযুত ফণা দুলিয়ে। ওই শোনো, সাপুড়ের তুবড়ি বাঁশির ডাক ‘ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন শনশন’! এসো আমার বিষধর কাল-কেউটের দল! তোমাদের বিবর ছেড়ে বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো এই দিনের রৌদ্র সিন্ধু-কূলে। তটিনী-তীরের কেতকী কুসুমে কুসুমে জড়িয়ে আছে যারা, কেয়ামূলের গোপন তলে আত্মগোপন করে আছে যারা, সেই নাগ-নাগিনিদেরে মনসার পূজা-বেদি হতে আজ ডাক এসেছে। ওই শোনো তাঁর দূত বাজায়, ‘ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন শনশন।’ তোমাদের আদিমাতা অগ্নিনাগিনি আজ গগনতলে বেরিয়ে এসেছে তার পুচ্ছে কোটি কোটি নাগ-শিশু খেলা করছে, ওই শোনো তার ডাক ঘনঘন শনশন! ওই শোনো সাপুড়ের গভীর গুরুগুরু ডম্বরু-রব। তারই রবে বিপুল উল্লাসে পুচ্ছ সাপটি উঠেছে দিকে দিকে নাগপুরে নাগ-নাগিনি, অধীর আবেগে বাসুকির ফণা দুলে দুলে উঠছে – বিসুবিয়াসের বিপুল রন্ধ্র দিয়ে তার নাসার বিষ-ফুৎকার শুরু হয়েছে। বেরিয়ে এসো – বেরিয়ে এসো ; বিবরের অন্ধকার হতে এই রৌদ্রদগ্ধ তপ্ত দিবালোকে হে আমার বিষধর কাল-ফণীর দল। তোমাদের বিষ-দাঁতের ছোবলে ছোবলে ধরণি জর্জরিত হয়ে উঠুক, তোমাদের অত্যুগ্র নিশ্বাসে নিশ্বাসে আকাশ তাম্রবর্ণ হয়ে উঠুক, বাতাসে বাতাসে জ্বালাদগ্ধ অগ্নি-দাহন হু-হু-হু-হু করে ছুটে যাক, তোমাদের কর্কশ পুচ্ছে জড়িয়ে বসুমতীর টুঁটি টিপে ধরো। তোমাদের বিষ-জরজর পুচ্ছকে চাবুক করে হানো – হানো – মারো এই মরা নিখিলবাসীর বুকে মুখে। বিষের রক্ত-জ্বালায় তারা মোচড় খেয়ে খেয়ে একবার শেষ আর্তনাদ কর উঠুক। খসে খসে পড়ুক তাদের রক্ত-মাংস-অস্থি তোমাদের বিষ-তিক্ত চাবুকের আঘাতে আঘাতে। গর্জন করো, গর্জন করো আমার হলাহলশিখ ভুজঙ্গ শিশুর দল! বিপুল রোষে তোমরা একবার ফণা তুলে তোমাদের পুচ্ছের উপর ভর করে দাঁড়াও, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠুক শুধু তোমাদের নিযুত কাল-ফণা। আকাশে-বাতাসে দুলুক শুধু তোমাদের নাগ-হিন্দোল। পাতালপুরের নিদ্রিত অগ্নিসিন্ধুতে ফুঁ দাও, ফুঁ দাও – ফুঁ দিয়ে জ্বালাও তাকে। আসুক নিখিল অগ্নিগিরির বিশ্ব-ধ্বংসী অগ্নিস্রাব, ভস্মস্তূপে পরিণত হোক এ-অরাজক বিশ্ব। ভগবান তার ভুল শোধরাক। এ খেয়ালের সৃষ্টিকে, অত্যাচারকে ধ্বংস করতে তোমাদের কোটি ফণা আস্ফালন করে ভগবানের সিংহাসন ঘিরে ফেলুক। জ্বালা দিয়ে জ্বালাও জ্বালাময় বিধি ও নিয়মকে।