- বইয়ের নামঃ দুর্দিনের যাত্রী
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ বুকস্ ফেয়ার
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল
এসো ভাই, পথের সাথি বন্ধুরা আমার, এসো আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দল! আজ শনি এসেছে তোমাদের পোড়া-কপালে বাসি ছাই-এর পাণ্ডুর টিকা পরিয়ে দিতে। এসো আমার লক্ষ্মীছাড়া গৃহহারা ভাইরা! আজ ঝর-ঝর বারিধারার সুরে সুরে কান্না উঠেছে – ‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতিহারা!’ এই ‘আকাশ-ভাঙা আকুল ধারার’ মাঝে নাঙ্গা শিরে আদুল গায়ে বেরিয়ে এসো – বেরিয়ে এসো আমার পথের সাথিরা। তোমাদের জন্য গৃহ নাই, তোমাদের জন্য দয়া নাই, করুণা নাই, এই দুর্দিনে তোমাদের ঘরে ডেকে নেবার কেউ নেই, তোমাদের ডাক দিয়েছে ওই ঝড়-বাদলের উতল হাওয়া আর মাটির মায়ের সিক্ত কোল। তোমাদের জন্যে কোনো গৃহের বাতায়নে কালো চোখের করুণ কামনা ঝিলিক মারে না, তোমাদের অভাবে এ দুর্দিনে কারুর মন্দিরে শূন্যতার ধ্বনি বাজে না, তোমাদের অভাবে কারুর হৃদয় পীড়িত হয়ে ওঠে না। এসো আমার অনাদৃত লাঞ্ছিত ভাইরা, আমরাই নতুন করে আমাদের জ্বালার জগৎ সৃষ্টি করব! শনি হবে আমাদের কপালে জয়টিকা, ‘ধূমকেতু’ হবে আমাদের রথ, মরুভূমি হবে আমাদের মাতৃক্রোড়, মৃত্যু হবে আমাদের বঁধু। এসো – এসো আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল! ত্যক্ত শতমুখী আমাদের বিজয়কেতন, মড়ার মাথা আমাদের রক্তদেউল-দ্বারে মঙ্গল-ঘট, গরল আমাদের তৃষ্ণার জল, দাবানল-শিখা আমাদের মলয়বাতাস, নিদাঘ-আতপ আমাদের তৃপ্তি, জাহান্নম আমাদের শান্তি-নিকেতন। এসো আমার শনির শাপদৃপ্ত ভাইরা! আমরা জয়নাদ করব অমঙ্গল আর অভিশাপের। সদ্য পুত্রহীনা জননী আর স্বামীহারা সদ্য-বিধবার সৃষ্টি-কাঁপানো ক্রন্দন আমাদের মাধবী-উৎসবের গান, মৃত্যু-কাতর মুখের যন্ত্রণা আমাদের হাসি, আর ওই যে ঘরে ঘরে মায়ের মমতা, বোনের স্নেহ, প্রেয়সীর ভালোবাসা – ওই আমাদের চোখের জল। ওই যে গৃহীর শান্তি, তৃপ্তি, আনন্দ, ওই আমাদের কান্না। ওই তরুণ কালো চোখের দীপ্তি আমাদের শিকল, ওই শূন্য হিয়ার ব্যথিত কামনা আমাদের কারাগার। ওই শ্মশান-মশান-চারিণী চণ্ডী আমাদের বীণাবাদিনী। মহামারি, মারিভয়, ধ্বংস আমাদের উল্লাস। রক্ত আমাদের তিলক, রৌদ্র আমাদের করুণা। এরই মাঝে আমাদের নবসৃষ্টির অভিনব তপস্যা শুরু হবে। এসো আমার রুদ্রতাপস তরুণের দল। সান্ধ্য-শ্মশান আর গোরস্থান আমাদের সান্ধ্য-সম্মিলনী, আলেয়া আমাদের সান্ধ্যপ্রদীপ, মড়া-কান্না আর পেচক-শিবাদি-রব আমাদের মঙ্গল হুলুধ্বনি। মরীচিকা আমাদের লক্ষ্য, আঘাত আমাদের আদর, মার আমাদের সোহাগ। সর্বনাশ আমাদের স্নেহ, বজ্র-মার আমাদের আলিঙ্গন। উল্কা আমাদের মালা-খসা ফুল, সাইক্লোন আমাদের প্রিয়ার এলোকেশ। সূর্যকুণ্ড আমাদের স্নানাগার, অনন্ত নরক আমাদের বিরাম-কুঞ্জ।
এই অমঙ্গল অভিশাপ আর শনির জ্বালানো রুদ্র-চুল্লির মধ্যে বসে তোমাদের নবসৃষ্টির সাধনা করতে হবে। তোমাদের এই রুদ্র তপস্যার প্রভাবে সকল নরকাগ্নি ফুল হয়ে ফুটে উঠবে, যেমন ‘ইব্রাহিমের’ পরশে ‘নমরুদের’ জাহান্নম ফুল হয়ে হেসে উঠেছিল। এসো আমার অভিনব তরুণ তপস্বীর দল! তোমাদের ধ্বংসের নামে আহ্বান করছি। এসো।
আমি সৈনিক
এখন দেশে সেই সেবকের দরকার যে-সেবক সৈনিক হতে পারবে।
সেবার ভার নেবে নারী কিংবা সেই পুরুষ, যে-পুরুষের মধ্যে নারীর-করুণা প্রবল। নারীর ভালোবাসা আর পুরুষের ভালোবাসা বিভিন্ন রকমের। নারীর ভালোবাসায় মমতা আর চোখের জলের করুণাই বেশি। পুরুষের ভালোবাসায় আঘাত আর বিদ্রোহই প্রধান।
দেশকে যে নারীর করুণা নিয়ে সেবা করে, সে পুরুষ নয়, হয়তো মহাপুরুষ। কিন্তু দেশ এখন চায়, মহাপুরুষ নয়। দেশ চায়, সেই পুরুষ যার ভালোবাসায় আঘাত আছে, বিদ্রোহ আছে। যে দেশকে ভালোবেসে শুধু চোখের জলই ফেলবে না, সে দরকার হলে আঘাতও করবে, প্রতিঘাতও বুক পেতে নেবে, বিদ্রোহ করবে। বিদ্রোহ করা, আঘাত করার পশুত্ব বা পৈশাচিকতাকে যে অনুভূতি নিষ্ঠুরতা বলে দোষ দেয় বা সহ্য করতে পারে না, সেই অনুভূতিই হচ্ছে নারীর অনুভূতি, মানুষের ওইটুকুই হচ্ছে দেবত্ব। যারা পুরুষ হবে, যারা দেশ-সৈনিক হবে, তাদের বাইরে ওই পশুত্বের বা অসুরত্বের বদনামটুকু সহ্য করে নিতে হবে। যে-ছেলের মনে সেবা করবার, বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার ইচ্ছাটা জন্মগত প্রবল, তার সৈনিক না হওয়াই উচিত। দেশের দুঃখ-আর্ত পীড়িতদের সেবার ভার এইসব ছেলেরা খুব ভালো করেই করতে পারবে। যেমন উত্তরবঙ্গের বন্যা-পীড়িতদের সেবা সাহায্য। বাংলার ত্যাগী ঋষি প্রফুল্লচন্দ্র আজ মায়ের মমতা নিয়ে দু-হাতে অন্নবস্ত্র বিলোচ্ছেন, এ রূপ জগদ্ধাত্রীর, এ রূপ অন্নপূর্ণার, এ রূপ, এ মূর্তি তো রুদ্রের নয়, প্রলয়ের দেবতার চোখে এমন মায়ের করুণা ক্ষরে না। এই যে হাজার হাজার ছেলেরা এই আর্তদের সেবার জন্য দু-বাহু বাড়িয়ে ছুটেছে, এ-ছোটা যে মায়ের ছোটা, এ-করুণা, এ-সেবা-প্রবণতা নারীর, দেবতার। আমরা এঁদের পূজা করি, এঁদের দেবত্বের কাছে মাথা অবনত করি, কিন্তু এতে তো দেশের বাইরের মুক্তি স্বাধীনতা আনবে না। রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, প্রফুল্ল বাংলার দেবতা, তাঁদের পূজার জন্য বাংলার চোখে জল চির-নিবেদিত থাকবে। কিন্তু সেনাপতি কই? সৈনিক কোথায়? কোথায় আঘাতের দেবতা, প্রলয়ের মহারুদ্র? সে-পুরুষ এসেছিল বিবেকানন্দ, সে-সেনাপতির পৌরুষ-হুংকার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কণ্ঠে।