কেবল সন্ত্রাসীদের হত্যা করে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। গোড়া থেকে সন্ত্রাস উপড়ে ফেলার সময় এসেছে। যতদিন সন্ত্রাসের সূতিকাগারগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস না হচ্ছে, ততদিন সন্ত্রাস চলবেই। ততদিন আমরা পৃথিবীর আনাচে কানাচে অপঘাতে মরবো। কোনও দেশ আর নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসীদের হাতে এখন একবিংশ শতাব্দীর অস্ত্র, মস্তিষ্কে সপ্তম শতাব্দীর অজ্ঞানতা।
মাঝে মাঝে ভাবি, আমেরিকা যদি আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করতো, খুন করার ট্রেনিং না দিতো, তাহলে কি ওরা খুন করতো না? হয়তো করতো। বাংলাদেশে যারা মুক্তচিন্তক ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের খুন করছে, তাদের তো আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না? চাপাতির সাপ্লাই তো আমেরিকা থেকে আসছে না। খুনীরা শরিয়া আইন অনুযায়ী পাথর ছুঁড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইউরোপ, ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না। ওসব লোকাল। বাংলাদেশেও জঙ্গী ট্রেনিং চলছে। আমেরিকার সাহায্য ছাড়াই চলছে।
শুধু অন্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে সমস্যার সমাধান কিছু হবে না। নিজেদের দোষও দেখতে হবে। দেখতে হবে আমাদের কিছু কিছু মসজিদ মাদ্রাসায় কী শেখানো হচ্ছে, ওয়াজে বা খুৎবায় কী বলা হচ্ছে। অমুসলিমদের এবং অবিশ্বাসীদের ঘৃণা করার কথা বলা হচ্ছে কি না, ওদের খুন করার কথা বলা হচ্ছে কি না। আজ যারা প্রগতিশীল লেখকদের কোপাচ্ছে, কাল তারা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের কোপালে অবাক হওয়ার কিছু কিন্তু নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যারা অশুভশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়, অশুভশক্তিই একদিন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস তা ই বলে।
প্যারিস হামলার পরপরই ফ্রান্সের গোয়েন্দারা পেয়ে গেছে সবগুলো সন্ত্রাসীর নাম ধাম চেয়ারা চরিত্র। সন্ত্রাসীদের হাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ পেতে পশ্চিমের দেশগুলোর খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না। কেবল আমারাই অদক্ষ লোক। আজও আমরা জানি না কে দাভোলকার, পানসারে, কালবুর্গির হত্যাকারী, কে হত্যা করেছে অভিজিৎ রায়কে, অনন্ত বিজয় দাশকে, ওয়াশিকুর বাবুকে, নিলয় নীলকে, ফায়সাল আরেফীন দীপনকে।
সুমন
সুমন চট্টোপাধ্যায় আজ এই সময় পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, যেটির খানিকটা চূর্ণীর ছবি নির্বাসিত নিয়ে। আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না সুমন এই কাজটা করেছেন, লিখেছেন। কারণ নির্বাসিতয় তো আড়ালে হলেও আমি আছি। আমি মানুষটা, যতদূর জানি, এই সময়ে একরকম নিষিদ্ধ। ইদানীং যে দুএকটি লেখা আমি এই সময়ে লিখেছি, তা আমাকে অন্য কেউ অনুরোধ করেছেন লিখতে, সুমন নন। সুমন তখন ছুটিতে ছিলেন। আমার লেখা বই প্রতিবছর প্রতিটি পত্রিকায় পাঠানো হয়, এই সময়েও হয়, প্রকাশক পাঠান। কিন্তু আজ বারো বছর হলো সেসব বইয়ের কোনও রিভিউ কোথাও ছাপানো হয় না। নির্বাসন নামের বইটিও পাঠানো হয়েছিল, যেখানে বর্ণনা করেছি কী করে কলকাতা থেকে, এবং শেষ অবধি ভারতবর্ষ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ওই বইটির সবটাই ফ্যাক্টস। সুমন বইটির রিভিউ করেননি বা কাউকে করতেও দেননি। কিন্তু এখন নির্বাসিতর প্রশংসা করছেন, যে ছবিটায় আছে আমাকে কলকাতা থেকে বের করার কাহিনী, যে কাহিনীর বেশির ভাগটাই ফিকশান। ফিকশানটা অতি সাবধানে করা, তাই ফিকশানটা কোনও হরর স্টোরি হয়ে ওঠেনি। ফ্যাক্টস কিন্তু ভয়ংকর।
সুমন লিখেছেন, দুঃখ করেই লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে ভুলে গেছে। ভুলে যদি যায়, তার জন্য দায়ি কিন্তু সাধারণ মানুষ নয়, দায়ি মিডিয়া। আমি, সাদা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার বয়কটের শিকার। আমার কিন্তু মনে হয় না, সাধারণ মানুষ আমাকে পুরোপুরিই ভুলে গেছে। এখনও মানুষ আমার বই কেনে। তবে মিডিয়া চেষ্টা করছে মানুষের মন থেকে আমাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে। এই যে নারীবাদ নিয়ে এত লেখা তিনি ছাপাচ্ছেন তাঁর পত্রিকায়, যাঁরা লিখছেন, তাঁদের অনেকেই দুদশকেরও বেশি আগে বলা আমার কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন। সুমন কিন্তু তারপরও আমার মত প্রকাশ করার কোনও সুযোগ আমাকে দেবেন না। সম্ভবত বলবেন, আমি বড় বাড়াবাড়ি করি। সুমন বাংলার মানুষকে বলেছেন আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর দৃশ্য দেখেও যারা মুখ বুজে ছিল, তারা যেন তাদের সেই মুখ বুজে থাকার লজ্জাটি নির্বাসিত দেখে মোচন করে। ছবিটা দেখলেই কি লজ্জামোচন হবে? সুমন কি আমার লেখা তাঁর এই সময়ে নিয়মিত ছাপিয়ে লজ্জামোচন করার কথা ভাবতে পারেন না?
আচ্ছা, স্বৈরতান্ত্রিক বুদ্ধদেব আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তারপর তো একটি মা মাটি মানুষএর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো, সেই মমতাময় সরকারও কেন আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলো না, সে ব্যাপারে সুমন একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেন? এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রশ্ন। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমাকে কী করে খুঁটি বানানো হচ্ছে জানেন, তাঁরা জানেন আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য একটি সংগঠিত ষড়যন্ত্র পশ্চিমবঙ্গে অনেককাল ধরেই চলছে।
বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকায় আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতাম। রাজ্য ছাড়া হওয়ার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রায়ই আনন্দবাজার আর প্রতিদিনে লিখতাম। সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রবিবাসরীয়তে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়েছে কিছু, সে চন্দ্ৰিলের কারণে। দেশ পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লিখতে বলা হতো, সেই পত্রিকায় তো লেখা বন্ধ করা হয়েছেই, এখন ধারাবাহিক ভাবে কুৎসা রটানো হচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ রোববারের জন্য আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখবো এ কথা সম্পাদকীয়তে সগর্বে ঘোষণা করেও লেখা ছাপাতে পারেননি। একটি লেখা ছাপানোর পরই আমার লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বইয়ের দেশ পত্রিকায় কী কী বই বেরোলো তার খবর ছাপা হয়, হাবিজাবি নানা বইয়ের খবরই থাকে, সযত্নে বাদ দেওয়া হয় আমার বই বেরোনোর খবর।