সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লজ্বন না হয়, তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে, হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়। একবিংশ শতাব্দি চলছে। মানুষ আর কবে সভ্য হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও বুঝি গুহায় বাস করছে মানুষ। হাজার বছর ধরে খেটে খুটে যা একখানা সমাজ বানিয়েছে, মুখতার জাঁকালো উৎসবই চলে প্রতিদিন। সমাজের চেহারা চরিত্র দেখলে মনে হয়, এগুলো আর কিছু নয়, এক একটা অন্ধকার গুহা। মানুষগুলো চোখ কান বন্ধ করে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গুহা থেকে বেরোচ্ছে না, চোখে আলো লাগবে এই ভয়ে আলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।
সন্ত্রাসের দুনিয়া
আমরা সন্ত্রাসের পৃথিবীতে বাস করছি। সন্ত্রাস চিরকালই অল্পবিস্তর ছিল। আমরা রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, দলীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, ব্যক্তি-সন্ত্রাস দেখেছি। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস ঠিক এভাবে দেখিনি। এই সন্ত্রাস শেষ অবধি কোথায় গিয়ে শেষ হয়, অনুমানও করাও সম্ভব নয়। ধর্মের নামে মানুষ খুন করা হচ্ছে চারদিকে। এর ফলে কী হচ্ছে? ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষ করে ফ্রান্সে, মুসলিম বিরোধী হয়ে উঠছে মানুষ। আমেরিকাতেও একই চিত্র। কথা ছিল দশ হাজার সিরিয়ার শরণার্থীকে আমেরিকা নেবে। এখন সেখানকার নাগরিকরা সাফ সাফ বলে দিচ্ছে, সিরিয়ার কোনও শরণার্থীকে তারা তাদের দেশে দেখতে চায় না। শরণার্থীর ভিড়ে জঙ্গীরা মিশে গেছে। প্যারিসের জঙ্গী হামলায় সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা শরণার্থী হয়ে সিরিয়া থেকে ইউরোপে ঢুকেছে। এসব খবর জানাজানি হওয়ার পর কী ভরসায় তাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে কথা বলবে আমেরিকার সাধারণ মানুষ!
আজ ফ্রান্সের আবালবৃদ্ধবনিতা লা মারসিয়েজ গাইছে। এই গান ভায়োলেন্সের গান। গানের কথাগুলো যে কোনও সভ্য মানুষকেই অস্বস্তি দেবে। অপবিত্র রক্তে দেশ ধুয়ে দেবো..– এটি যে কোনও কারণেই হোক, ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত। এটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অনেকেই অবশ্য পছন্দ করে না। এই জাতীয় সঙ্গীত কট্টর ডানপন্থীদের পছন্দ হলেও বামপন্থীরা প্রায়ই এর সমালোচনা করেছে। কিন্তু এখন সকলে মিলে এই সঙ্গীতটি গাইছে। এটি এখন ফ্রান্সকে এক করার লক্ষ্যে গাওয়া হচ্ছে। এই ভায়োলেন্সের গানটি এত গাওয়ার পর, আমি জানি না, শেষ অবধি ফরাসিরা শান্তির গান গাইতে আগ্রহী হবে কি না।
প্যারিসের জঙ্গি হামলার নীল নকশা এঁকেছে আবদেল হামিদ আবাউদ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মোলেনবিক এলাকায় মরক্কো থেকে আসা মধ্যবিত্ত ইমিগ্রান্ট পরিবারে তার জন্ম। পড়াশোনা করেছে ব্ৰাসলসের নামিদামি ইস্কুল কলেজে। কিন্তু একসময় দুষ্টচিন্তা ঢোকে মস্তিষ্কে। কলেজ ছেড়ে দিয়ে আবদেল হামিদ ড্রাগ ডিলারদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে, ছোট ছোট ক্রাইম করতেও অভ্যস্ত হয়ে। পড়ে। এসব কারণে জেলও খেটেছে কয়েক বছর আগে। আবদেল হামিদ সালাফি ইসলামের আদর্শে গড়ে ওঠা কেউ নয়। দারুল ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত কোরান হাদিস ঠোঁটস্থ করে রাখা, নামাজ রোজা করা কোনও সাচ্চা মুসলমান নয়। সিরিয়ায় গিয়ে মানুষ-মারার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী সালাহ আবদেসসালাম এবং আরও কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারের বীতশ্রদ্ধ ফরাসিভাষী মুসলমান নিয়ে সে প্যারিসে হামলা করার পরিকল্পনা করে। দলে সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা সিরিয়ার শরণার্থী দলে মিশে গিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে। স্টেডিয়ামের বাইরে প্রথম আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোরণটি সেই ঘটিয়েছে। হামলায় আবদেল হামিদের জঙ্গী বন্ধুরা মোটামুটি সাকসেসফুল। ১২৯ জন মানুষকে হত্যা করা কম কথা নয়। আবদেল হামিদের রাগ আমেরিকা আর ইউরোপের ওপর, মুসলমানের রক্তে দুনিয়া ভেজাচ্ছে ওরা, এখন ওদের রক্তের হোলি খেলতে হবে। মূলত ঘৃণা আর রাগ থেকেই নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। আইসিস লিডার আবু মোহাম্মদ আল আদনানি অথবা আল বাগদাদির অনুমতি নিয়েই সম্ভবত হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা এঁকেছিল আবদেল হামিদ। অনুমতি না নিলেও প্যারিসের টেরর অ্যাটাকের দায় আইসিস দল নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছে। সব হত্যাকাণ্ড অবশ্যই ইসলামের নামে। আবদেল হামিদের পরিবারের লোকরা চায় আবদেল হামিদ মরে যাক। সে তার নিজের ছোট ভাই ইউনেসকে আইসিসে ঢুকিয়েছিল, তার বাবা ওমর তখন আবদেল হামিদের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল। এই জঙ্গী ছেলে মরে গেলে পরিবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা অখুশি নয়, বরং খুশিই হবে।
আবদেল হামিদকে এখন পুলিশ খুঁজে চলেছে। নিশ্চয়ই পেয়েও যাবে একদিন। ওর পরিণতি আমরা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি। কেন মানুষ জেনে বুঝে জঙ্গীদলে যোগ দেয়? এই প্রশ্নটি অনেকে করে। কী আকর্ষণ এই আইসিসের। সোজা সরল উত্তর, ইসলামি খেলাফতের ঘোষণা দিয়েছে বলে। টাকা পয়সা অঢেল আছে বলে। এই আইসিস আলকায়দা থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল। আইসিস ছোট ক্রাইম করবে, আল কায়দা নাইন ইলেভেনের মতো বড় কিছু। এরকম একটা অলিখিত চুক্তি সম্ভবত আছে। আমেরিকার ভয় আলকায়দাকে নিয়ে, আইসিসকে নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নয় আমেরিকা। আইসিসকে একরকম গড়েছে তারা, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে হটানোর জন্য। অবশ্য আইসিস যে শেষ অবধি এমন ভয়ংকর ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠবে, তা আমেরিকার কল্পনাতেও আসেনি। তালিবানকেও একসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে গড়েছিল, সেও ফ্রাংকেনস্টাইন হয়েছে। আর কত সন্ত্রাসী দল জন্ম দেবে আমেরিকা! ইরাকে যুদ্ধটি না করলে ইরাকী আল কায়দার জন্ম হতো না, আইসিসেরও হয়তো জন্ম হতো না। আজ আইসিসকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিন বললেন, চল্লিশটি দেশ আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। চল্লিশটি দেশের মধ্যে, অনুমান করছি, বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ।