লিঙ্গান্তর করে যদিও একশ ভাগ পুরুষ বা একশ ভাগ নারী হওয়া যায় না, কিন্তু যতটুকুই হওয়া যায়, তাতে যদি সুখ পায় মানুষ, সুখ পাওয়ার অধিকার তাদের একশ ভাগ।
নাতালি নামে আমার এক বন্ধু এখন আপাদমস্তক মেয়ে। কদিন আগে তার গোটা শরীরটাই ছিল পুরুষের। তার মন তার শরীরকে কখনও মেনে নেয়নি। শুধু নারীর পোশাক পরে নাতালির নারী হওয়ার সাধ মেটেনি, লিঙ্গ বদলে ফেলে সে তার সাধ মিটিয়েছে। নিজের শরীর নিয়ে যা কিছু করার অধিকার তার আছে। কাউকে কৈফিয়তই বা দিতে হবে কেন সে কী করেছে বা যা করেছে কেন করেছে? নাতালিকে মেয়ে বলে না মানা মানে নাতালিকে অশ্রদ্ধা করা, নাতালির মানবাধিকার, ট্রান্সঅধিকার লঙ্ন করা। পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল, সেই পুরুষাঙ্গটির কারণে লিঙ্গান্তরিত নাতালিকে এখন পুরুষ বলে সম্বোধন করলে তাকে ঘোরতর অপমান করা হয়। ওই কাজটা আমি অন্তত করিনি। তাকে মিস্টার এক্স বলিনি, মিস নাতালি বলেই ডেকেছি। যারা লিঙ্গ বদলে নিয়েছে শুধু তাদেরই কেন, শরীরে আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের নারী বলে মনে করছে, বিশ্বাস করছে, তাদেরও নারী হিসেবেই সম্বোধন করা উচিত সবার।
পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তাহলে দুনিয়াটা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুঁটে আর বোরিং কিছু একটা হত। ভালো যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভালো যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইতো, তাহলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকতো না দুনিয়ায়।
প্রচুর মেয়ে ওয়াই ক্রোমোজম নিয়ে দিব্যি জীপন যাপন করছে। জিনটা পুরুষের, কিন্তু অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম থাকার কারণে অ্যান্ড্রাজেন রিসেপটর কম, ফলে পুরুষ হরমোন বেরিয়ে যে ভ্রুণকে পুরোপুরি পুরুষের দ্রুণ করে গড়ে তুলবে, তা হয় না। কলকাতার পিংকি প্রামাণিক সম্ভবত এই সিনড্রামের শিকার। আবার ওদিকে অনেকে আছে, জিনটা মেয়েদের, কিন্তু কনজেনিটাল অ্যাডরেনাল হাইপারপ্লাসিয়া হওয়াতে মেয়েদের হরমোন জোটে না, সে কারণে তারা মেয়ে হয়েও ঠিক মেয়ে নয়।
নারীর যৌন আকর্ষণ পুরুষের জন্য, আর পুরুষের যৌন আকর্ষণ নারীর জন্য, এটাই ন্যাচারাল, বা প্রাকৃতিক, বাকি সব অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরুদ্ধ–এরকম ভাবাটা সম্পূর্ণ ভুল। সমকামীর সংখ্যা দুনিয়াতে যে কম নয়, তা মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সব সমকামীকেই এক বাক্সে ফেলা যায় না। সমকামীরা যে সবাই একশভাগ সমকামী তা নয়। বাইজেণ্ডার বা উভকামীর সংখ্যাও প্রচুর। সব উভকামীও একশ ভাগ উভকামী নয়। পুরুষ আর নারীর প্রতি কোনও কোনও উভকামী একই রকম যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ কেউ আবার ভিন্ন রকম।
বিচিত্র সব কাম চারদিকে। কেউ কেউ বহুঁকামী বা পলিজেণ্ডার। কেউ আবার সর্বকামী বা প্যানজেণ্ডার। কেউ কিন্তু নিস্কামী। কোনওরকম কামের বালাই নেই। খাঁটি এজেণ্ডার বা জেন্ডার নিউট্রাল যাকে বলে। আবার জেণ্ডারকুইয়ারও আছে, যারা নিজেদের নারীও মনে করে না, পুরুষও মনে করে না, বা দুটোই মনে করে, দুটোতেই সাঁতার কাটে, তাদের যৌনপরিচয়-যৌনবোধ-যৌনতা সব একাকার হয়ে যায়। সব কামই, সব যৌন আচরণই–যত কম সংখ্যক লোকই সে আচরণ করুক না কেন–প্রাকৃতিক, যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর ভ্যারিয়শনকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।
প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়াও শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌনপ্রবৃত্তি; সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা। সমকামিতা আগাগোড়া বাস্তব, এ কোনও ব্যতিক্রমী কাম নয়, বিকল্প যৌনতা নয়। সমকামিতা বিষমকামিতার বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, বনোবো, যাদের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ-র মিল শতকরা আটানব্বই ভাগ, ভীষণই উভকামী। প্রকৃতি শুধু প্রজনন করো, প্রজাতি টেকাও মন্ত্র জপে না। প্রকৃতি আরও অনেক কিছু করে। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও সমকামিরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়। যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য বংশ বিস্তার করা নয়। সামাজিকতাও যৌনতার উদ্দেশ্য। বনোবোরা হাতের কাছে স্ব-প্রজাতির যাকেই পায়, তার সঙ্গেই যৌনসঙ্গম করে, এর ফলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুতা গড়ে ওঠে, একজনের বিপদে-বিপর্যয়ে আরেকজন দাঁড়ায়, সকলে মিলে নিজেদের প্রজাতিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচায়। যদি বংশ বিস্তারই প্রজাতির টিকে থাকার পেছনে একমাত্র পদ্ধতি হত, তাহলে পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতাদের জগতে এত বন্ধ্যা সৈন্য থাকতো না, যাদের কাজ বংশ বিস্তার করা নয়, বরং প্রজাতিকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করা।
সমকামীদের এককালে মানসিক রোগী বলা হত। ভয়াবহ নির্যাতন করা হত সমকামীদের। সমকামকে জেনেটিক রোগও একসময় বলা হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, এ জেনেটিক ভেরিয়েশন বা জেনেটিক কারণ হতে পারে, জেনেটিক রোগ নয়। আর, সমকামিতা কোনও অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম নয়, কোনও মানসিক রোগ তো নয়ই।