মেয়েরা ছেলেদের মতো আচরণ করলে আজকাল তবু সহ্য করে মানুষ, কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের মতো আচরণ করলে আজও অধিকাংশ মানুষ সহ্য করে না। দ্বিতীয়। লিঙ্গ প্রথম লিঙ্গকে অনুকরণ করে করুক, কিন্তু প্রথম লিঙ্গের লিঙ্গাভিমান এমনই যে, দ্বিতীয় লিঙ্গের কিছু অনুকরণ করার মানে দাঁড় করায় প্রথম লিঙ্গের অপমান। মেয়েরা দিব্যি ছেলেদের মতো পোশাক পরছে, ব্যবসাবাণিজ্য করছে, ছেলেদের মতো মদগাঁজা খাচ্ছে, মোটরবাইক চালাচ্ছে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র, বিজ্ঞানী বৈমানিক হচ্ছে, নেতা মন্ত্রী হচ্ছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে, মানুষ খুন করছে। আর, ওদিকে, ছেলেরা চোখে সামান্য একটু কাজল, ঠোঁটে একটুখানি লিপস্টিক আর মেয়েদের মতো জামা জুতো পরলেই সমাজের ভিত কেঁপে ওঠে।
মানুষ তার নিজের জীবনটা যাপন করবে, নাকি নিজের যৌন পরিচয়কে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার যুদ্ধই করে যাবে সারা জীবন? নিজের যৌনপরিচয় দেবার ভার নিজের কাছে থাকলে উটকো অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচে মানুষ। তুমি নিজেকে যে লিঙ্গের মানুষ বলে মনে করছে, কেউ মানুক বা না মানুক, সেটাই তোমার সত্যিকারের লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন পরিচয়।
কোনও পুরুষ যদি বলে সে নারী, অথবা কোনও নারী যদি বলে সে পুরুষ অথবা কোনও নারী বা পুরুষ যদি বলে সে নারীও নয় পুরুষও নয়, পাগল সন্দেহ না করে তাকে বরং আমাদের বিশ্বাস করা উচিত। কারণ একমাত্র সেই মানুষটাই জানে সে কী। আমাদের সমাজ এখনও নারী আর পুরুষের ভাঙা-ভোঁতা সংজ্ঞা খাড়া করে। জোর গলায় বলে, যাদের শরীরে এক্স এক্স ক্রোমোজম, তারা কেউ পুরুষ হতে পারে, আর যাদের শরীরে এক্স ওয়াই, তারা কেউ নারী হতে পারে না! কেন হতে পারে, শুনি? নিশ্চয়ই হতে পারে। কোনও ক্রোমোজম আর কোনও জৈবলিঙ্গের ওপর মনোলিঙ্গ নির্ভর করে না। শরীরের বাহ্যিক বৈশিষ্টের ওপর নির্ভর করে না, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ডাক্তার বদ্যি তাকে কী লিঙ্গে চিহ্নিত করলো, তার ওপরও নির্ভর করে না। জেণ্ডার বা মনোলিঙ্গ সেক্স বা জৈবলিঙ্গের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেটে ছিঁড়ে মাড়িয়ে পুড়িয়ে গলিয়ে থেতলে আর যে লিঙ্গকেই দূর করা যাক, মনের লিঙ্গকে করা যায় না। জৈবলিঙ্গটা শরীর, মনোলিঙ্গটা আইডেনটিটি, প্রেজেনটেশন, সে এক্সপ্রেশন,ইন্টারপারসোনাল সম্পর্ক, সোশিয়-কালচারাল রোল।
কোনও মেয়ে তার নিজের শরীরের দিকে তাকালেই যদি দেখে শরীরটা অন্য কারো, শরীরটা অচেনা, অদ্ভুত, শরীরটা পুরুষের, যে শরীরটা তার শরীর হলেও তার শরীর নয়, শরীরটাকে নিজের বলে ভাবতে তার অস্বস্তি হয়, কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়, এ শরীর তাকে শুধুই দুঃসহবাস দেয়, তবে কী করবে সে? গুমরে গুমরে একলা ঘরে কাঁদবে সারা জীবন? দরজা বন্ধ করে সকলের চোখের আড়ালে পুরুষের পোশাক খুলে নারীর পোশাক পরে চোরের মত নিজেকে দেখবে আয়নায়, বছরের পর বছর? বন্ধ দরজাটা খুললেই বা সত্য উচ্চারণ করলেই লোকের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হবে তাকে। এ কার দোষ, তার, নকি যারা বাস্তবকে মেনে নেয় না, তাদের? এ তাদের দোষ, যারা প্রকৃতির এক রূপকে স্বীকার করে, আরেক রূপকে করে না, যারা মনে করে দুনিয়াতে সিসজেন্ডারই বা অরূপান্তরকামীরাই সত্য, ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরা নয়, যারা মনে করে নারী ও পুরুষের যৌনআকর্ষণই সঠিক যৌন আকর্ষণ, বাকি সব যৌন আকর্ষণ ভুল, মিথ্যে।
তুমি ট্রান্সজেণ্ডার, রূপান্তরকামী। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে এখন ট্রান্সসেক্সয়াল হয়েছো। তুমি সাজতে ভালোবাসো, গয়না পরতে ভালোবাসো, মেয়েদের পোশাক পরতে পছন্দ করো, পুরুষের সঙ্গে শুতে পছন্দ করো, তাই বলে কিন্তু তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করোনি। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছো, কারণ তুমি মূলত নারী, তুমি তোমার মতো করে তোমার নারীত্বকে প্রকাশ করেছে। তোমার জোর নারীর, তোমার শরীরটা দেখতে আকাশ বাতাস হাতি ঘোড়া এক্স ওয়াই যা কিছুই হোক না কেন, তুমি মনে প্রাণে, অন্তরে বিশ্বাসে নারী। যৌনসম্পর্কের জন্য পুরুষকে পছন্দ না করে, তুমি কোনও মেয়েকেও পছন্দ করতে পারতে। সম্ভবত তুমি মনে মনে বিষমকামী বা হেটারোসেজুয়াল নারী বলেই পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেছো। তুমি কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষকে বিষমকামিতার সুখ দিতে নিজের লিঙ্গ বদলাওনি, তুমি লিঙ্গ বদলেছো কারণ তোমার ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছিল একটা পুরুষের শরীরকে বছরের পর বছর অকারণে বহন করতে, এ অনেকটা কাঁধে হিমালয় নিয়ে হাঁটার মতো। ভালুকের ছাল পরে প্রতিটা দিন যাপন করলে আমার ঠিক কেমন বোধ হবে, ভাবি। ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের বোধহয় ঠিক সেরকমই অসহ্য অস্বস্তি হয় আর ওই ওপরের আবরণটা খোলসটা ঝামেলাটা উপদ্রপটা খুলে ফেলতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। লিঙ্গ-বদল সব ট্রান্সরা করে না। কেউ কেউ করে। করুক বা না করুক, করার অধিকার সবারই আছে। মানবাধিকার সবার জন্যই।
জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা একে কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন বা মস্তিষ্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে- সেই লিঙ্গকে যদি শরীরে স্থাপন করতে চায় করুক। অনাকাঙ্ক্ষিত অবাঞ্ছিত লিঙ্গের বোঝা শরীরে বহন করে জীবনভর ভোগা থেকে বাঁচুক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেলা যদি সম্ভব হয় তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করবো, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার নাকি অন্যের?