সেদিন এক লোক আমাকে বললো, মেয়েদের পেশির জোর কম, পুরুষের পেশির জোর বেশি, তাই পুরুষের স্থান উঁচুতে, মেয়েদের স্থান নিচে, তাই চাকরিতে মাইনেটা মেয়েরা কম পায়, পুরুষরা পায় বেশি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরিগুলো কি নারী পুরুষের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হওয়ার চাকরি, যেখানে শরীরের পেশির প্রয়োজন হয়? লোকটি ভুরু কুঁচকে বলেছে, না। আমিও ভুরু কুঁচকে বললাম, তবে পেশির প্রশ্ন ওঠে কেন? এও বললাম, আমরা পেশি দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোনওটাই চালাই না। আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে চালাই সব। নারী পুরুষের মস্তিষ্কে তো কোনও পার্থক্য নেই বলেই জানি। লোকটি এরপর কোনও উত্তর দিতে পারেনি। সম্ভবত কুৎসিত কোনও গালি খুঁজছিল আমার দিকে ছোঁড়ার জন্য। জুৎসই উত্তর না থাকলে কুৎসিত গালিই ওদের ভরসা।
সবার আগে এই নারীবিদ্বেষী বিশ্বাসগুলোকে বিনাশ করতে হবে। এসবের বিনাস না হলে এসব বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে লিঙ্গ বৈষম্য গড়ে উঠেছে, সেই লিঙ্গ বৈষম্যকে বিনাশ করা সম্ভব নয়। অসুখ দূর করতে হলে অসুখের কারণ দূর করতে হয়, তা না হলে অসুখ সারে না।
পৃথিবীর জনশক্তির অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনশক্তিকে যদি দুর্বল বলে ভাবা হয়, ছলে বলে কৌশলে যদি তাদের পারদর্শিতা দেখানোর সবরকম সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়, যদি তাদের শোষণ করা হয়, যদি তাদের কাজকে কাজ বলে না ভাবা হয়, উপার্জনকে উপার্জন বলে গণ্য করা না হয়, যদি তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের না দেওয়া হয়, তাদের সমতা আর সমানাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস না করা হয়, কর্মঠ, নিষ্ঠ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমতি, দায়িত্বশীল, ও দক্ষ হওয়ার পরও যদি তাদের তুচ্ছ করা হয়, শুধু মেয়ে বলেই তুচ্ছ করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির! আবারও বলছি, মেয়ে বলেই যদি তাদের হাঁড়ি ঠেলার, রাঁধা-বাড়ার, সন্তান জন্ম দেওয়ার বস্তু, আর আবেগের পিণ্ড বলে ভাবা হয়, মেয়ে বলেই যদি তাদের কিছু কম-বুদ্ধির, কিছু কম-সম্মানের, কিছু কম মর্যাদার কিছু কম মানুষ বলে মনে করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির। এইসব অসুস্থ ভাবনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে আখেরে মুক্তি নেই কারোর।
লজ্জা দিবস
২২ নভেম্বর, ২০০৭ সাল। আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এই বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা দেড়-দুবছর ধরেই চলছিল। যে বইটি বামফ্রন্ট সরকার নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৩ সালে, সেটিকে দুবছর পর কলকাতা হাইকোর্ট মুক্তি দেয়। বইয়ের এই মুক্তি পাওয়া বামপন্থীরা পছন্দ করেননি। থেকে থেকেই বলছিলেন রাজ্য ছাড়তে। চাপটা চরমে উঠলো হায়দারাবাদে মুসলিম মৌলবাদীরা আমার ওপর হামলা করার পর। কলকাতায় আমাকে গৃহবন্দি করা হলো। পুলিশ কমিশনার বাড়িতে এসে থ্রেট করতেন। রাজ্য ছাড়ার জন্য হুকুম দিতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহকে দিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বলতেন আমি যেন কলকাতা ছাড়ি। এমনকী বাড়িওয়ালা ডাক্তার দেবল সেনকে দিয়েও বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছিলেন। এমন সময় পার্ক সার্কাসের গলিতে মুসলমানদের বের করা হলো। ছিল নন্দীগ্রাম,সিঙ্গুর আর রিজওয়ানকে নিয়ে বিক্ষোভ, হয়ে দাঁড়ালো তসলিমার ডিপোর্টেশনের পক্ষে মিছিল।
মুসলমানের আপরাইজিং হলে মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুরেও হতো। কোথাও কিন্তু কিছু হয়নি। পার্কসার্কাসের মুসলমানরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সামনেই গাড়িটাড়ি পোড়ালো। খামোকা আর্মি নামানো হয়েছিল, মনে আছে। কাফু ঢাকা হয়েছিল। মশা মারতে কামান দাগা বোধহয় একেই বলে।
বামফ্রন্ট সরকার মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য আমাকে তাড়িয়েছিল, কিন্তু মুসলমানের ভোট তাদের পাওয়া হয়নি। সামনেই ছিল পঞ্চায়েত ইলেকশন। সেই ইলেকশনো গোহারা হেরেছিল বামফ্রন্ট। (আজও রাজনীতিকদের এই শিক্ষাটা হয়নি যে তসলিমাকে গৃহবন্দি করে, মেরে, তাড়িয়ে, তার সর্বনাশ করে, তার টিভি সিরিয়াল ব্যান করে, তার বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল করে মুসলমানের ভোট জোটেনা, জোটেনি কোনওকালে।)
এরপর তো ফতোয়াবাজরা ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিরাট জনসভা করে আমার মাথার দাম আনলিমিটিড অ্যামাউন্ট টাকা ঘোষণা করলো। হায়দারাবাদি মোল্লাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তিনি এবং কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম ছিলেন ফতোয়া ঘোষণার নায়ক। এই যে কারও মুণ্ডু কেটে নিয়ে এলে হাজার কোটি অথবা যত ইচ্ছে টাকা চাও তো দেবো বলা হলো, এর জন্য কারও কোনও শাস্তি হলো না। পুলিশ ছিল সভায়, ফতোয়াবাজদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতেই ছিল। ওই ফতোয়াবাজ ইমাম আবার বামফ্রন্ট সরকারের, এবং এখনকার তৃণমুলী সরকারের পরম বন্ধু।
কলকাতা থেকে তাড়াবার পর কিছু বন্ধু, খুব সাধারণ বন্ধু, প্রতিবাদ করতো এই ২২ নভেম্বর তারিখে। নাম দিয়েছিল এই দিনটির, লজ্জা দিবস। একজন বাঙালি লেখক, যে ভালোবেসে কলকাতায় থাকতো, তাকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়াটা কলকাতার জন্য লজ্জা, সে কারণেই ২২ নভেম্বরের দিনটিকে ওরা লজ্জা দিবস বলতো। তসলিমাকে কলকাতায় ফেরত চাই বলে বলে প্রতিবছর চিৎকার করতো ওরা কয়েকজন বড় লেখক কবি আসতেন প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে। ওই লেখক কবিরা তৃণমুলে ভিড়ে যাবার পর অবশ্য এ পথ আর মাড়ান না। লজ্জা দিবস বলে। কোনও দিবসের কথাও ওঁদের আর স্মরণ নেই।
লিঁও
ফ্রান্সের শহর লিও। ২০০৯ সাল। আমাকে লিওর মেয়র ফ্রেঞ্চ সোশালিস্ট পার্টির জেরার্ড কলোম্ব দিলেন লিওর সর্বোচ্চ সম্মান। পেলাম মেডেল অব লিও। একই সঙ্গে পেলাম লিওর সাম্মানিক নাগরিকত্ব, অনারারি সিটিজেনশিপ। নিজের দেশের সরকার লাথি মেরে তাড়ায়, আমার নাগরিকত্ব অস্বীকার করে, আর অন্য দেশ, অন্য শহর আমাকে নাগরিকত্ব দিয়ে ঘোষণা করে এতে নাকি তাঁরাই সম্মানিত। শুধু লিও নয়, ইউরোপের অনেকগুলো শহর আমাকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিয়েছে। ওই শহরগুলোর কোনওটিতেই আমি বাস করিনি। বাস করতে চেয়েছি শুধু সেই শহরগুলোয়, যে শহরগুলোয় প্রবেশ করার আমার কোনও অধিকার নেই। যেমন ঢাকা, যেমন কলকাতা।
লিঙ্গসূত্র
তেরো বছর বয়স আমার তখন। একদিন শুনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। নাম ছিল আবুল হোসেন, মেয়ে হওয়ার পর নাম হোসনে আরা। কদিন পরই লাল বেনারসি পরে হোসনে আরা বিয়ে করে ফেললো তার রুমমেটকে। ঘটনাটা আমকে খুব আলোড়িত করেছিল। খবরের কাগজে আবুল হোসেন আর হোসনে আরা ছবি পাশাপাশি ছাপা হত। আবুল হোসেন সবসময় মৌলানাদের স্কার্ফের মতো একটা স্কার্ফ পরতো, বুক আড়াল করার জন্য। ভেতরে ভেতরে মেয়েই ছিল সে, কিন্তু জন্মের পর আত্মীয় স্বজন ভেবেছিল সে ছেলে, ভাবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। বড় হয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পেরেছিল সে ছেলে নয়। লজ্জায় ভয়ে অনেক বছর কাউকে কিছু বলেনি। ছেলেদের হোস্টেলে থাকতো, সবাই তাকে ছেলে বলেই জানতো। কিন্তু একসময় অস্বস্তির চরমে পৌঁছে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। ডাক্তার কী একটা অপারেশন করলেন, ব্যস, আবুল হোসেন মেয়ে হয়ে গেল। খবরটা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল হঠাৎ একদিন ছেলে হয়ে যাওয়ার। কিন্তু বুঝতাম, আবুল হোসেনের শরীরটা যেমন ভেতরে ভেতরে মেয়ের শরীর ছিল, আমার শরীরটা ভেতরে ভেতরে ছেলের শরীর নয়। আসলে মেয়েদের ওপর পারিবারিক সামাজিক ধার্মিক রাষ্ট্রিক অত্যাচার এত বেশি হত যে ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে এসব থেকে বাঁচতে চাইতাম। অন্য কোনও কারণ ছিল না।