আমির খানের বিরুদ্ধে যে কাণ্ডগুলো হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হচ্ছে সমাজের অসহিষ্ণুতা নিয়ে আমির খানের আশংকা একেবারেই অমূলক ছিল না। আমির খানের নিন্দুকরাই আমির খানের কথার সত্যতা প্রমাণ করছে। একবার মনে হয় আমির খান যা-ই বলুন, তাঁর মতো তারকার কখনও ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আসবে না। আবার এও মনে হয়, মকবুল ফিদা হোসেনের মতো তারকার যদি সেই পরিস্থিতি আসতে পারে, আমির খানেরও আসতে পারে। দেশকে ভালোবাসেন বলেই আমির খান দেশে কোনও অরাজকতা চান না। আমিও এ দেশকে ভালোবাসি বলে চাই এ দেশে নারী পুরুষের সমতা থাকুক, অন্যায় অত্যাচার দারিদ্র বৈষম্য দূর হোক, ধর্মান্ধতা কুসংস্কার ঘুচে যাক, বাক স্বাধীনতা মুক্তি পাক, মানুষ সভ্য হোক, বিজ্ঞানমনস্ক হোক। যখন এ দেশে ঘটতে থাকা মন্দ বিভৎস ঘটনার সমালোচনা করি, এদেশি কিছু জাতীয়তাবাদী আমাকে গালি দিয়ে অনুযোগ করে, এ দেশের নিন্দা করছি আমি। কী করে বোঝাই, দেশটার ভালো চাই বলে সমোলোচনা করি, যেন মন্দ বিভৎস ঘটনা আর কখনও না ঘটে। ওই জাতীয়বাদীরা মনে করে, মন্দ বিভৎস ঘটনাগুলো কার্পেটের তলায় রেখে চোখ বুজে জোরে সোরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ফেললেই দেশকে ভালোবাসা হয়ে গেলো। দেশকে আমি ওদের চেয়ে অন্যভাবে ভালোবাসি। ক্ষতকে আড়াল করে নয়, ক্ষতের চিকিৎসা করে শরীরে সুস্থতা আনার পক্ষে আমি।
আমির খানকে একজন প্রশ্ন করেছে, মুম্বই হঠাৎ তাঁর কাছে হঠাৎ অনিরাপদ জায়গা হয়ে পড়ছে কেন! এত যে মুসলমানদের বোমাবাজি হলো মুম্বইয়ে, সন্ত্রাসী হামলা হলো, তখন তো আমির খান অনিরাপদ বোধ করেননি! হ্যাঁ, একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো কথা নয়! কিন্তু হয়তো আমির খান তখনও অনিরাপদ বোধ করেছিলেন। হয়তো প্রকাশ করেননি। হয়তো অনেকে মনে করেন, মুসলিম মৌলবাদীদের গালাগালি দেওয়ার চেয়ে হিন্দু মৌলবাদীদের গালিগালি দেওয়া নিরাপদ। এ কিন্তু একদিক থেকে প্রমাণ করে হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলিম মৌলবাদীদের মতো ভয়ংকর নয়।
সব সমাজেই অসহিষ্ণু লোক থাকে। আমেরিকা ইউরোপেও আছে, এশিয়া আফ্রিকাতেও আছে। ভারতবর্ষকে অসহিষ্ণু আখ্যা না দিয়ে বরং অসহিষ্ণু মানুষকে অসহিষ্ণ আখ্যা দেওয়া উচিত। ভারতবর্ষের সংবিধান এবং আইন কোনওরকম অসহিষ্ণুতাকে উৎসাহ দেয় বলে আমি করি না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, যতদূর জানি, হিন্দু কট্টরপন্থীদের কোনও অসভ্য কার্যকলাপে হাততালি দেননি। কেউ কেউ বলছেন, দাদরি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে তাঁর উচিত ছিল আখলাকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করা। নরেন্দ্র দাভোলকার বা গোবিন্দ পানসারেকেও তো মেরে ফেলা হয়েছে তাদের ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের জন্য। অসহিষ্ণুতা তো এই সরকারের আমলেই প্রথম নয়, সব সরকারের আমলেই ঘটেছে, তখন তো সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে, দেশ রসাতলে গেলো এরকম হাহাকার শুরু হয়নি! আসলে সত্যি বলতে কী, দেশ এবং মানুষ ধীরে ধীরে আগের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য হচ্ছে। বর্বরতার পরিমাণ আগে অনেক বেশি ছিল এখনকার চেয়ে। এখন ধর্ণ হলে, খুন হলে, আমরা জেনে যাই। কোথাও কোনও অসহিষ্ণুতা ঘটলে মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় খবর। এখন মানুষ জানে যে মেয়েদের পেটানো বা ন্যাংটো করে বাজারে ঘোরানো, বা ধর্ষণ করা বা প্রাণে মেরে ফেলা অন্যায়। ক্যাশিশুদের জ্যান্ত পুঁতে ফেললে মানুষ এখন ছি ছি করে। একসময় এসব কাজকে উচিত কাজ বলেই ভাবতো লোকেরা। একসময় ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার স্বাভাবিক ছিল, এখন ওগুলো নিন্দার বিষয়। শূদ্রকে শূদ্র বলে ঘাড়ধাক্কা দেওয়াটা চোখে লাগতো না। এখন লাগে। এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি মানবাধিকারে, নারীর অধিকারে, সমতা আর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে। দীর্ঘকাল যাবৎ যে মুক্তলুদ্ধির চর্চা চলেছে সমাজে, এ তারই ফল।
ভারতবর্যে, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা পৃথিবীতেই লড়াই চলছে। এই লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষ। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন মর্নিং ওয়াকে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারবো বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকবে, তাকে আমি চাপাতি চালিয়ে খুন করবো। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাবো না, তার গালে আমি চড়ও দেবো না। আমি লিখবো। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করি। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাক স্বাধীনতার এই শর্তটি আজকাল অনেকেই জানেন। জানলেও কিছু কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী এই শর্তটি মোটেও মানতে চান না।
লক্ষ করছি হিন্দু মৌলবাদীদের একটা ভয়, হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃতি বুঝি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভয় মুসলিম মৌলবাদই বা ইসলামই এর বিলুপ্তির কারণ। সুতরাং ধর্ম টিকিয়ে রাখার জন্য মুসলিম মৌলবাদীরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করছে, তারাও তাই করছে। তারাও যুক্তিবাদীদের, বিধর্মীদের, অবিশ্বাসীদের হত্যা করতে শুরু করেছে।