ভারত প্রচুর সাহায্য করছে নেপালকে। আশে পাশের অনেক দেশই সাহায্য করছে। পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়েছে খাবার। কিন্তু সে খাবারে নাকি ছিল গরুর মাংস। গরুর মাংস, আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে সুস্বাদু মাংস। কিন্তু মুশকিল হলো নেপালের অধিকাংশ লোক হিন্দু, তারা পুজো পার্বণে মোষ মেরে সর্বনাশ করলেও গরুর মাংস মুখে দেবে না। গরুকে দেবতা ভাবে বলে গরুর মাংস খায় না। ভারতেও তাই। এখানে তো প্রায়ই আমি চেঁচাই, দেবতা ভাবো তো এদের এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন! তোমরা দেবতাদের পেচ্ছাব পান করছো, অথচ এই দিল্লিতে দেখছি গরুরা রাস্তায় ক্ষুধার্ত হাঁটে, কোথাও কোনও খাবার নেই, ফুটপাতের আবর্জনা ঘেঁটে প্লাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে বাঁচে। দিল্লির সবুজ ঘাসে ছাওয়া পার্কগুলোয় কোনও দেবতার ঢোকার কোনও অনুমতি নেই। ভারতেও তো গরু জবাই নিষিদ্ধ। ভারতের গরুগুলো কোথাও কোথাও জবাই হতে চলে যায়। মাংস না খেলেই যে লোক পশুর অধিকারে বিশ্বাস করে, এ কথা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। পশুর অধিকারকে বেশির ভাগই দুপয়সার মূল্য দেয় না। পশুর মাংস খায় না কারণ ধর্ম বলেছে খেও না, অথবা জন্ম থেকে খেয়ে অভ্যেস নেই বলেই খায় না। পশুর অধিকার নিয়ে যারা আন্দোলন করে তারা বেশির ভাগই আমিষ খেয়ে অভ্যস্ত। গরুর মাংস না খাওয়ার পেছনে। ভালো কোনও যুক্তি হয়তো নেই, কিন্তু যখন কেউ খাচ্ছে না, তার সেই না খাওয়ার অধিকারকে সম্মান জানানো উচিত। অন্তত আমি জানাই।
একবার আমার কলকাতার বাড়িতে আমি গরুর মাংস বেঁধেছিলাম। আমার এক হিন্দু বন্ধুর খুব শখ ছিল গরুর মাংস খাবে। ওই নিয়ে এসেছিলো মাংস। আমি সুজাতাকে, যে মেয়েটা আমার বাড়িতে কাজ করতো, বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। ও ভেবেছিল আমি পাঁঠার মাংস রান্না করছি। গরুর মাংসের কথা জানলে ও হয়তো তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যেতো, এবং কোথাও না খেয়ে কষ্ট করতো। এত ভালো মাইনের চাকরি তো ওর কোথাও জুটবে না। সে কারণে ওকে আমি বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। কিন্তু ওকে সে মাংস স্পর্শও করতে দিইনি, সে মাংস রান্না হলে ওকে খেতেও দিইনি। ওকে রান্না ঘরের বাইরেই রেখেছি। ওর জন্য সেদিন আলাদা করে মাছ রান্না হয়েছিল। আমি বলেছি, আজ এই মাংস তোমাকে দিচ্ছি না, কারণ এ আমি আর আমার বন্ধু দুজনই খেয়ে শেষ করবো পণ করেছি। সুজাতাকে বলতে পারতাম, এ পাঁঠার মাংস, দিতেও পারতাম কিছু টুকরো ওর পাতে। কিন্তু মিথ্যে বলা আর অসততা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই করিনি।
কোনও মুসলমান আত্মীয় বা বন্ধু পাশে থাকলে আমি শুয়োরের মাংসটা একটু আড়াল করেই খাই, শুয়োর খাওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ আবদার করি না। কী রকম হতো যদি ভুমিকম্পে বাংলাদেশ ধ্বংস হতো, আর কোনও দেশ বাংলাদেশকে সাহায্য পাঠাতে ট্রাক বোঝাই শুয়োরের মাংস! বাংলাদেশ কী করতো! ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানাতে আমি শুয়োরের মাংস মুসলমান থেকে, বা গরুর মাংস হিন্দু থেকে আড়াল করি না। আমি অধিকারকে সম্মান জানাই। ওই মাংস তারা খেতে চায় না, তাদের না খাওয়ার অধিকারকে আমি সম্মান জানাই। আমি যেমন সাপ খাই না, কুকুর বেড়ালের মাংস খাই না। আমাকে যারা সম্মান করে, তারা নিশ্চয়ই আমাকে ওই মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করবে না।
নেপালে খাদ্য পাঠানোর জন্য নিশ্চয়ই পাকিস্তানের দুটে তিনটে লোক জড়িত ছিল না, নিশ্চয়ই অনেক লোক ছিল। ওই অনেকের মধ্যে কি কারও জানা ছিল না যে নেপাল একটা হিন্দু প্রধান দেশ এবং নেপালের লোকরা গরুর মাংস খায় না? এই তথ্যটা কেউ একবারও জানায়নি কাউকে, ভেবে অবাক হয়ে যাই। সে কারণে সংশয়, কাজটা কি ইচ্ছে করে করা হয়েছে, নাকি অন্যান্য ভুলের মতো এটিও একটি ভুল!
মনে আছে সেই গল্পটা, এক দুষ্ট শেয়াল একবার এক বককে নেমন্তন্ন করলো। খেতে দিলো চ্যাপ্টা থালায়। বকও নেমন্তন্ন করেছিল প্রতিশোধ নিতে। খেতে দিয়েছিল লম্বা গলাওয়ালা বোতলে। অতিথিরা প্রায় কিছুই খেতে পারেনি। কী লাভ এই নেমন্তন্নে, যদি ক্ষিধেই না মেটে, যদি তৃপ্তিই না হয়!
পাকিস্তানের উচিত গরুর মাংস ফিরিয়ে নেওয়া। বরং গরুর পরিবর্তে ভেড়া বা খাসি বা মুরগির মাংস দেবার ব্যবস্থা করা। অথবা কিছুই না দেওয়া। খাবার জন্য অখাদ্য কিছু দেওয়ার চেয়ে কিছু না দেওয়া অনেক ভালো।
মা
একসময় আমি কেশবতী ছিলাম। কেশের কিছু দুর্লভ ছবি পেয়েছি। ছবিগুলো আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে তোলা। মা আমার কেশ নিয়ে মেতে থাকতেন দিন রাত। নারকেল তেল লাগাতেন, আচড়াতেন, উকুন থাকলে বেছে দিতেন, সাদা কালো ফিতে দিয়ে কলাবেণী করে দিতেন। কেশ চিরকালই আমার জন্য ছিল ভীষণ এক ঝামেলা। স্নান করে ভেজা কেশ কী করবো বুঝে না পেয়ে হাতখোঁপা করে ইস্কুলে যেতাম। আমার দুতিনটে কেশ মাটিতে পড়লো কী পড়লো না, মা কেঁদে বুক ভাসাতেন। মূলত আমার চুল গুলো আমার জন্য আমার মাথায় ছিল না, ছিল মার জন্য। একদিন একটুখানি বড় হওয়ার পর মার আবেগের নিকুচি করে কোমর অবধি লম্বা চুলকে ঘাড়ের কাছে ঘচাং। মা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন।
মাকে সারাজীবন কম কষ্ট দিইনি। মার আবেগ নিয়ে কত মশকরা করেছি। এখন মা নেই। এখন দুঃখ হয়। এখন আমার চুলের যা ইচ্ছে তাই হোক, কেউ আহা উঁহু করবে না। মা তাঁর নিজের চুলগুলো অযত্নে অযত্নে নষ্ট করেছেন। কিন্তু আমার চুলের যত্ন তিনি নিরলস করে গেছেন। ভালোবাসা ছাড়া মার দেবার আর কিছু ছিল না। এই ভালোবাসাই সম্পূর্ণ উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন। আমার অনেক কিছু ছিল। আমি আর কাউকে দিতে কার্পণ্য না করলেও মাকে দিতেই করেছি। ভেবেছি, মা ই তো। মাকে আবার দিতে হবে কেন। মাকেই যে দিতে হয়, বুঝিনি।
মানুষ মানুষের জন্য?
কয়েক হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে। জল তাদের নিচ্ছে, কিন্তু স্থল তাদের নিচ্ছে না। আসলে স্থলের আপত্তি নেই, আপত্তি স্থলের প্রাণীদের। অবশ্য স্থলের অন্য প্রাণীদের কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু মানুষ নামক প্রাণীর। যারা সমুদ্রে ঠিকানাহীন ভাসছে, তারা কিন্তু মানুষই।