এমন ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। শুধু ব্লগার নয়, কোনও মেয়ের শরীরে বোরখা নেই তো রাস্তায় সে মেয়েকে দুটুকরো করে ফেলে রাখবে খুনিরা, দুটো ছেলে মেয়ে কোথাও বসে প্রেম করছে দেখলে দুটোকেই কোপাবে। কেউ ধর্মীয় শাসন মানতে আপত্তি করবে তো প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে জবাই করবে। এমন দিন আসছে সামনে। এমন যুগ। সেই যুগের নাম ইসলামী শরিয়ার যুগ।
৯. ১ জন ব্লগার গ্রেট খায়, ১০ জন ব্লগার ব্লগ গুটিয়ে ফেলে। ১ জন ব্লগার কোপ খায়, ১০০ জন ব্লগার ব্লগ লেখা বন্ধ করে দেয়। এরকমই মনে হচ্ছে। এভাবেই বাঙালির অতি স্বল্প আয়ুর যুক্তিবাদের যুগ বা এজ অব রিজনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। ব্লগারদের পাশে দেশের শিল্পী সাহিত্যিক, দেশের বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী কেউ নেই। এসব দেখে মনে পড়ছে ২২ বছর আগে আমার পাশেও খুব বেশি কেউ ছিল না। অলমোস্ট একা আমি ভারসেস গোটা দেশ ইনক্লডিং অপদার্থ সরকার। লক্ষ মৌলবাদী শহর জুড়ে লম্ফঝম্ফ করছে, আমার মুণ্ডুর জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছে। কোথায় আমার পাশে দাঁড়াবে সরকার, তা নয় আমার বিরুদ্ধেই কেস দিয়ে বসলো। তখন আইটি অ্যাক্ট ছিল না, তখন পিনাল কোডের ২৯৫ এ ই সাহসী লেখককে মেরে ফেলার জন্য যখেষ্ট। হাতে গোণা কিছু বুদ্ধিজীবী গোপনে গোপনে অবশ্য ছিল পাশে। ওরকম থাকায় লাভ কিছু হয় না। যদি দেশজুড়ে বিক্ষোভ হতো ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে যদি অন্তত পাঁচশ লোকও দাঁড়াতো, তাহলে কারও সাধ্য ছিল না আমাকে দেশ থেকে তখন বের করে। সেই দুযুগ আগের ঘটনাকেই যেন পূনরায় ঘটতে দেখছি এখন। এখনও প্রগতিশীল ব্লগারদের খুন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ নেই। ইঁদুরের মতো সবাই গর্তে লুকিয়ে পড়েছে। যাদের সচেতন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বলে মনে করা হয়, তারাও লুকিয়েছে। স্টুপিড সরকার দেশের জনগণকেও ছলে বলে কৌশলে স্টুপিড বানিয়েছে। ডেমোক্রেসি নেই বাংলাদেশে, যা আছে তার নাম ইডিওক্রেসি।
ভূমিকম্প, গরুর মাংস
আমরা কী ভীষণ অসহায়, তাই না? মাটি একটু নড়ে ওঠে আর আমরা হাজার হাজার মানুষ মরে যাই। সমুদ্রে জল একটু উথলে ওঠে আর আমরা ভেসে যাই হাজার হাজার মানুষ। প্রকৃতির সামনে এতই অসহায় আমরা অথচ ভাব দেখাচ্ছি আমাদের মতো শক্তিমান আর কেউ নেই। আমরা অন্য সব প্রজাতিকে বন্দি করি, নির্যাতন করি, আমাদের ক্রীতদাস বানাই। আমরা এই নিষ্ঠুর প্রজাতির নাম দিয়েছি সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা কবিতা আওড়াই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই। আসলে আমরা খুব নির্লজ্জ প্রজাতি। প্রাণীজগতে হায়েনা ছাড়া মানুষের মতো আর কেউ এত নির্লজ্জ নয়।
ভূমিকম্পে নেপালের কত হাজার মানুষ পিঁপড়ের মতো মরে গেলো। জানিনা আর কী দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক দুর্যোগে তো পৃথিবীর সমস্ত ডায়নোসোর মরে গিয়েছিলো। মানুষ এখন ডায়নোসারের মতো পৃথিবী শাসন করে। ডায়নোসোরকে ভয় পেয়ে চলতো অন্যান্য প্রজাতি। মানুষকেও ভয় পেলে চলে এখনকার বেশির ভাগ প্রজাতিই। অত শক্তিমান ডায়নোসোরকে যদি বিলুপ্ত হতে হয়, তবে মানুষকে কেন হবে না? নতুন নতুন রোগ আসছে। নতুন নতুন উপদ্রব। আর বিরুদ্ধ প্রকৃতি তো আছেই।
অন্যান্য প্রজাতি আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য লোকে বলবে, অনেক। বলবে, মানুষের মস্তিষ্ক অন্য প্রজাতির মস্তিষ্কের চেয়ে উন্নতমানের। তা মানি। কিন্তু মানুষ যেভাবে ধর্ম আর কুসংস্কারগুলো বানিয়েছে এবং হাজার বছর ধরে তার চর্চা করে যাচ্ছে, তা দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় অন্যান্য প্রাণীই বরং মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান। তারা কোনও আজগুবি গল্প তৈরি করে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে না। নিজেদের তুলোর মতো উড়িয়ে দেওয়ার মতো পারমাণবিক অস্ত্রও কিছু বানাচ্ছে না।
আমরা ভালোবাসতে জানি। পশুরাও ভালোবাসতে জানে। ওদের ভালোবাসাটা বরং অকৃত্রিম। মানুষ তো অভিনয়ে দক্ষ। পশুর এই জিনিসটা ভালো লাগে আমার, অভিনয় জানে না। কোনও হাতি মারা গেলে তার আত্মীয় বন্ধুরা যেভাবে কাঁদে, মানুষের জন্যও বোধহয় কোনও মানুষ অমন কাঁদে না। পশুদের শুধু নিজের বাচ্চার প্রতিই যে মমতা তা নয়। ভালোবাসা আর সহমর্মিতা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত জরুরি, শুধু নিজের প্রজাতির জন্য নয়, অন্য প্রজাতির জন্যও। কত পাখি জেনে শুনে অন্য পাখির বাচ্চাকে লালন পালন করে! কত পশু বন্ধু হয়ে ওঠে অন্য পশুর!
কী ভেবেছি আমরা নিজেদের? আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, যেহেতু কিছু মেশিন টেশিন অস্ত্র উস্ত্র বানিয়েছি। এগুলো আমরা আমাদের হিংসে বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করি, মানুষ ধ্বংস করি, সভ্যতা নষ্ট করি। ভূমিকম্পে আমরা টের পাই নিজেদের যত শক্তিমান বলে ভাবি, তত শক্তিমান আমরা নই। মানুষ নিষ্ঠুর জানি, কিন্তু মানুষ সমমর্মীও হতে পারে প্রচণ্ড। ভূমিকম্পেও এর প্রমাণ আমরা দেখি। পৃথিবীর গরিব ধনী সব দেশই এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। মানুষকে বাঁচাতে মানুষ দৌড়ে আসে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবনের ঝাঁকি নিয়ে অসহায়কে উদ্ধার করা, খাবার দাবার, পানীয় জল, ওষুধ পত্র যা কিছুরই প্রয়োজন উদার হাতে দুর্গতদের দান করা–তুলনা হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের এক করে। আমরা মানুষরা সুখে এক হই না। দুঃখে এক হই। কিন্তু তা কি ঠিক? লক্ষ লক্ষ গরিবের দুঃখের পাশে ধনীরা তো দাঁড়ায়। না। দাঁড়ালে সারা পৃথিবী জুড়ে ধনী দরিদ্রর ফারাকটা এত বিশাল হতো না।