গত রোববার সকালে কর্ণাটকের ধারবাদে কালবুরগির বাড়ির দরজায় একটি ছেলে বেল বাজিয়েছে। ছেলেটি একা আসেনি, সঙ্গে একজন ছিল। সে ছিল বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে বসা। বেল শুনে কালবুরগির স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। ছেলেটি বললো সে কালবুরগি স্যারের ছাত্র, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে কালবুরগিকে ডেকে দিলেন স্ত্রী। নিজে চলে গেলেন কিচেনে। কিচেনে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলেন গুলির শব্দ। দৌড়ে এসে দেখতে পান মরে পড়ে আছেন কালবুরগি। কালবুরগি স্যারের কপালে আর বুকে গুলি করেই অপেক্ষারত মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায় খুনী।
কে বা কারা মেরেছে কালবুরগিকে, তা আমরা অনুমান করতে পারি। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল আগেই। দিয়েছিল কারণ গত বছর কোনও এক সেমিনারে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন মূর্তিপূজা টুজা নেহাতই অর্থহীন। এমনকী তিনি নাকি বলেছিলেন, দেব দেবীর মূর্তিতে চাইলে পেচ্ছাব করা যায়। কট্টরপন্থী হিন্দুরা রেগে আগুন হয়েছে তাঁর ওপর। কালবুরগি, সাহিত্য একাডেমির পুরস্কার পাওয়া লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটাক্ষই শুধু করেননি, এর দুঃসহ জাতপাতের বিরুদ্ধেও অবিরাম প্রতিবাদ করেছেন।
নরেন্দ্র দাভোলকারকে প্রায় একইভাবে খুন করা হয়েছে, ২০১৩ সালে। থাকতেন মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে। প্রতিদিনকার মতো সকালে হাঁটাতে বেরিয়েছিলেন, তখনই মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে একজন তাঁকে গুলি করে চলে যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দ পানসারেকেও একই পদ্ধতিতে খুন করা হয়। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে খুনীদের গ্রেফতার করার জন্য। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখানেই তফাৎ। বাংলাদেশের সরকার কিন্তু এটা বলছে না যে তারা যে করেই হোক খুনীদের খুঁজে বের করবে। ভারত কিন্তু বলছে।
কালবুরগি ছিলেন সৎ ও সাহসী, যুক্তিবাদী গবেষক এবং প্রাচীন কন্নড় সাহিত্যের শিক্ষক। হামপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও তিনি ছিলেন। পেরুমাল মুরুগান নামের এক তামিল লেখক হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি পেয়ে তাঁর ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন, পেরুমাল মুরুগান মরে গেছে। পেরুমাল প্রতিজ্ঞা করেছেন লেখালেখি ছেড়ে দেবেন। হুমকি এসেছে, কিন্তু শেষ অবধি পেরুমাল মরেননি। মরেছেন কালবুরগি। কালবুরগির বয়স ছিল ৭৭। মৃত্যুর কোনও হুমকিকে সিরিয়াসলি নেননি। সরকার তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছিলেন, কিন্তু দেড় বছর পর কী মনে করে পুলিশ উঠিয়ে নিয়েছেন।
কালবুরগি অনন্তমূর্তিকে সমর্থন করতেন, যে অনন্তমূর্তি লিখেছিলেন ছোটবেলায় তিনি দেব-দেবীর মূর্তির ওপর পেচ্ছাব করতেন। এই ঘটনা ডানপন্থীদের প্রচণ্ড ক্ষেপিয়েছিল। কালবুরগি কর্ণাটকের লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীতে তাঁরাই ছিলেন, যাঁরা বহুঈশ্বরবাদে নন, বরং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। শিবকে মানেন। কিন্তু বেদ মানেন না, জাত পাত মানেন না। কুসংস্কার মানেন না। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠী সম্ভবত অনেকটা বাংলার ব্রাহ্মসমাজের মতো। এই গোষ্ঠীকে কালবুরগি হিন্দু বলে স্বীকার করেন না। এটিও একটি কারণ হিন্দুদের রাগ করার।
কী হচ্ছে এই উপমহাদেশে? মুসলিম মৌলবাদ যেমন বাড়ছে, হিন্দু মৌলবাদও বাড়ছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ঘৃণা বাড়ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাস বাড়ছে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তকদের মাথায় কোপ পড়ে, ভারতের মুক্তচিন্তকদের মাথা লক্ষ করে গুলি ছোঁড়া হয়। এ দেশের মুক্তচিন্তকদের সমর্থন করবে, কিন্তু ও দেশের মুক্তচিন্তকদের সমর্থন করবে না–আর যে-ই হোক, এটি আমি নই আমি সব দেশের সব মুক্তচিন্তকের পাশে দাঁড়াই, এবং সব দেশের সব সন্ত্রাসীর বিপক্ষে লড়ি, তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যা করে সমাজের কোনও উপকার হয় না। বরং এভাবে চলতে থাকলে সমাজ একসময় বুদ্ধিহীন হয়ে উঠবে। মানুষ অন্ধকারে পড়ে থাকবে, সেখান থেকে তাদের বাঁচাবার, অন্ধকারে বাতি জ্বালাবার, কেউ আর থাকবে না।
এ দেশে অভিজিৎ, অনন্ত, ওয়াশিকুর, নীলকে ইসলামি সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরেছে। ও দেশে দাভোলকার, পানেসার, কালবুরগিকে হিন্দু সন্ত্রাসীরা গুলি করে মেরেছে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অভিজিত্রা, দাভোলকাররা সরব ছিলেন। যুক্তিবাদীরা তো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েন। কুসংস্কারে, অন্ধত্বে, অজ্ঞতায় যাদের বিশ্বাস তারা আলোকিত মানুষের বড় ভয় পায়। তাই তাঁদের যে করে তোক সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীটার দখল নিতে চায় নিজেরা।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা এই উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ জানে না। জানে না যে এ আমি নিশ্চিত। হিন্দু মুসলিম দু গোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের মুখেই একটা কথা শুনি, যে, বাক স্বাধীনতার মানে এই নয় যে তুমি ধর্ম নিয়ে কথা বলবে, বা অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। অধিকাংশ লোক মানুক বা না মানুক, আসলে বাক স্বাধীনতা মানে কিন্তু ওটিই। আঘাত দেওয়ার অধিকারটিই। আঘাত না দিলে বাক স্বাধীনতা বলতে কোনও কিছুর কোনও প্রয়োজনও পড়তো না।
সমাজ যাঁরা বদলাতে চান, তাঁরা চিরকালই নিন্দিত হয়েছেন রক্ষণশীল সমাজের উগ্রপন্থী রক্ষণশীল দ্বারা। যুগে যুগে স্বপ্নবান সেইসব মানুষ স্বপ্ন রচনা করে গেছেন নিজের জীবনকে বিপন্ন করে। তাঁরা কারাভোগ করেছেন, নির্বাসিত হয়েছেন, ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তাঁদের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই পুরোনো অজ্ঞতা আর অন্ধকারের যুগের এখনও অবসান হয়নি। আমরা হয়তো মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য বাক্স-প্যাঁটরা গোছাচ্ছি, আমরা হয়তো আমাদেরই তৈরি দুরবীনে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে অন্য গ্যালাক্সির ভেতরে অন্য গ্রহ দেখতে পাওয়ার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠেছি, এখনও আমরা ধর্মের নামে মানুষ খুন করি।