মাঝেমাঝে ভাবলে গাশিউরে ওঠে, কী করে এই নারীবিদ্বেষী সমাজে আমি বেড়ে উঠেছি, স্বনির্ভর হয়েছি, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচেছি। তা কি আর সহজ ছিলো? শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিয়েও, স্বনির্ভর হয়েও, আমার পথচলা সহজ হয়নি বাংলাদেশে। পদে পদে বাধা ছিল। আমিই যদি অত বাধার মুখোমুখি হই, তবে অন্যরা কতো বড় বাধার সামনে পড়ে তা অনুমান করতে পারি। প্রতিটি সিঁড়ি নারীকে ভাঙতে হয়, যে সিঁড়িগুলোর প্রতিটিই এক একটি মৃত্যুফাঁদ। পুরুষের সিঁড়ি পুরুষরা বানিয়েছে তরতর করে উঠে যাওয়ার জন্য। এমনি বৈষম্যের পৃথিবীতে বাস করি আমরা। পুরুষদের বড় ভালোবেসে বাস করি। পুরুষদের বড় আপন ভেবে বাস করি। পুরুষদের তৈরি এই বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন করলে আমাদের পুরুষবিদ্বেষী বলে গালি দেয় পুরুষরা। আমরা এই গালিকে ভীষণ ভয় পাই। তাই হাসিমুখে বরণ করি পুরুষের দেওয়া সকল নির্যাতন। আমাদের তো সহিষ্ণ হতে হবে। পুরুষরা অনেক আগেই বলে দিয়েছে আমদের হতে হবে ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণ। আমরা তা ই হতে চেষ্টা করি। আর যদি ববিতার মতো অবাধ্য হই, তবে তো সমাজের সবাই মিলে আমাদের বাঁশ দিয়ে পেটাবে। সে কি আমরা জানি না? ববিতার ঘটনা আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। একটু অন্যরকম করে ঘটে, এই যা।
অসহিষ্ণুতা
অন্যের মত, আদর্শ, বিশ্বাস, ব্যবহার যারা মানতে আগ্রহী নয়, তাদেরই অসহিষ্ণু বলি আমরা। ইদানীং শিক্ষিত শহুরে লোকরা ভারতে অসহিষ্ণতা বাড়ছে কি না এ নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন। বেশির ভাগ লোকই এই বিতর্কের কথা না জেনে, যেমন অসহিষ্ণ তেমনই থেকে যাচ্ছেন। এখনও নারীর প্রতি পুরুষ অসহিষ্ণু। এখনও গরিবের প্রতি ধনী অসহিষ্ণু। এখনও এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোকদের প্রতি, এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ আরেক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু। খুন খারাবি করলেই সে অসহিষ্ণ, তা না হলে নয়, তা তো নয়। যারা গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের খুন করেছে, হিন্দু ধর্মের বা কুসংস্কারের নিন্দা করেছিলেন বলে কালবুরগিকে যারা খুন করেছে, তারা শুধু অসহিষ্ণু নয়, তারা বর্বর, ধর্মান্ধ খুনী, ক্রিমিনাল।
লেখক বুদ্ধিজীবীদের অনেকে তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবাদের এ এক নতুন রূপ। যে যেভাবে প্রতিবাদ করতে পছন্দ করেন, সেভাবে করছেন। অনেকে বলছেন, রুশদির বই যখন নিষিদ্ধ করা হলো, তাঁকে যখন কলকাতায় বা জয়পুর লিট ফেস্টে যেতে দেওয়া হলো না, অথবা তসলিমাকে যখন হায়দারাবাদে আক্রমণ করা হলো, তাঁকে যখন কলকাতা থেকে বা ভারত থেকে বের করে দেওয়া হলো, তখন কোথায় ছিল ওই লেখক বুদ্ধিজীবীদের চেতনা? তখন কেন পুরস্কার ফেরত দেননি ওঁরা? মোদ্দা কথা, মুসলিম মৌলবাদীরা অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ আপনারা করেন না, কেবল হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায় করলেই প্রতিবাদ করেন? যদি করেনই, আপত্তি কেন? আমি সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে দাঁড়াই। কেউ যদি তা না করতে চান, যদি কেউ মনে করেন, একটি ধর্মের মৌলবাদের বিপক্ষেই তিনি দাঁড়াবেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আমি যাবো কেন, যদি আমি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি? বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের লেখক বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দেশের মুসলিম মৌলবাদীদের বিপক্ষে লড়েন, হিন্দু বা ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের বিপক্ষে নয়। নিরীহ সংখ্যালঘুর প্রতি সব দেশের বুদ্ধিজীবীদের সহানুভুতি কাজ করে। তবে ঠিক এভাবে সব দেশের সব সংখ্যালঘুকে বিচার করা চলে না। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু বা ক্রিশ্চান এবং ভারতের সংখ্যালঘু ক্রিশ্চান বা মুসলমান একই রকম নিরীহ নয়, একইভাবে তারা নির্যাতিতও হয় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েও মৌলবাদী থিকথিক করছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মৌলবাদীর চেয়ে তারাও কম যায় না। বাংলাদেশে এখনও হিন্দু মৌলবাদীরা শাস্ত্র মতে চলার পক্ষপাতী, নারীর সমানাধিকারের পক্ষে যে কোনও আইনের তারা ঘোর বিরোধী। ভারতেও একই হাল। সংখ্যালঘু মুসলমান কোরানের আইনে চলবে, সভ্য আইন নৈব নৈব চ।
অসহিষ্ণুতা নিয়ে কত কাণ্ডই না হচ্ছে। আমির খান বললেন তাঁর স্ত্রী নাকি ভারত ছাড়ার কথা উঠিয়েছেন। বাহ, অমনি শুরু হয়ে গেল আমিরের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক। শিবসেনার কেউ কেউ তো ঘোষণা করে দিল আমির খানের গালে যে চড় মারতে পারবে, তাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। শুনে আমার মনে পড়লোদুহাজার চার সালে কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম ঘোষণা করেছিল, আমার মুখে চুনকালি দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার। শুধু টাকার অংকটায় আর সময়টায় পার্থক্য, তাছাড়া সব তো এক।
তারপরও আমি হিন্দু আর মুসলিম সন্ত্রাসীদের এক কাতারে রাখি না। সারা বিশ্বে আজ মুসলিম সন্ত্রাসীরা যে কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার তুলনায় হিন্দু সন্ত্রাসীরাকিছুই করছে না। আইসিস, বোকো হারাম, আল শাবাব, আল কায়দা, লস্করই তৈবা, হিজবুল্লাহ, হিজবুত তাহিরি এসবের কাছাকাছি আসতে পারবে কোনও আরএসএস, শিবসেনার দল। যেভাবে ওরা গলা কাটছে মানুষের, যে ভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, হিন্দু সন্ত্রাসীদের পক্ষে তা কোনওকালেই সম্ভব নয়। সেদিন একজন বললো, হিন্দুরা যদি মুসলিমদের মতো গলা কাটার সুযোগ পেতো, গলা কাটতো। সুযোগ পাচ্ছে না বলে করছে না।