চোখ কপালে তোলে বন্ধুরা।
ওদের শেষ অবধি রাজি করাতে পেরেছি, একবার রাঁধলে একবেলা নয়, দুবেলা খাবে। কিন্তু আজ বেঁধে কাল খাওয়াটা বা পরশু খাওয়াটা মানেনি। আমাকে প্রতিদিন রাঁধতে হয়েছে। কোনওদিন যদি রাঁধতে না পারি, ওদের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেছি। আগের দিনের খাবার দিইনি। আগের দিনের খাবারগুলো শুধু আমি খেয়েছি।
রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার জানে না বেশির ভাগ লোক। ফ্রিজারেও কাঁচা মাছ মাংস রাখে না খুব। কিন্তু ফ্যাশনের আরামবাগ ফ্রোজেন চিকেন বাজারে এলে সেটা কেনার ধুম পড়ে যায়। তখন ফ্রেশ চিকেন ভালো লাগে না। জ্যান্ত মুরগি বাজারে রেখে দোকানের ফ্রিজার থেকে চিকেন কিনে এনে রান্না করে খায় আর আহা কী স্বাদ আহা কী স্বাদ বলে। বড়লোকরা পছন্দ করে বলে মধ্যবিত্তরাও ওই চিকেনে স্বাদটা দ্রুত পেয়ে যায়।
একবার কলকাতার যদুবাজার থেকে আমি পাঙ্গাস মাছ এনেছিলাম। বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছি। বন্ধুরা অন্য যা যা খাবার ছিল, খেলো, পাঙ্গাস মাছের নাম শুনে ছিটকে সরে গেলো। ও মাছ খাবে না, কারণ ও মাছ আগে খায়নি অথবা ও মাছের নাম শোনেনি। অচেনা কোনও খাদ্য চেখে দেখতে কেউ রাজি নয়। সবই হতে হবে চেনা। জন্ম থেকে খেয়ে এসেছে, এমন চেনা।
একবার চিতল মাছের মুইঠ্যা বানিয়েছিলাম। মুইঠ্যা ওই আমি প্রথম বানিয়েছি। এবং আশ্চর্য ভালো হয়েছিল সেই মুইঠ্যা। মুইঠ্যা খেতে বন্ধুরা এলো। সবাই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে হাত চাটতে লাগলো। সক্কলে বললো, এমন সুস্বাদু মুইঠ্যা তারা তাদের জীবনে খায়নি কোনওদিন। এটা তাদের লাইফের বেস্ট মুইঠ্যা। মুইঠ্যার প্রশংসা চললো আরও কয়েক ঘণ্টা। তারপর, সবাই যখন যাবে, তখনই কথা প্রসঙ্গে বললাম, যদুবাজার থেকে কিনেছিলাম চিতল মাছটা। বিশাল ছিল মাছটা। পেটিগুলো বেঁধেছি। আর মুইঠ্যার জন্য কাঁটামুক্ত মাছ সরিয়ে রেখেছিলাম। কতদিন ভেবেছি মুইঠ্যা বানাবো। আর হয়ে ওঠেনি। প্রতি মাসেই ভাবি এ মাসেই নামাবো মাছটা ফ্রিজার থেকে। ফ্রিজারের এত তলায় পড়ে গিয়েছিল যে ওই প্যাকেটটা খুব চোখে পড়তো না। ছমাস পরে বের করেছি।
বন্ধুদের চোখ কপালে। অস্ফুট স্বরে বললো, কী বললে?
আমি বললাম, ছমাস।যে মাছটা দিয়ে মুইঠ্যা বানিয়েছি সে মাছটা ছমাস ফ্রিজারে ছিল।
–ছমাস এই মুইঠ্যার মাছ ফ্রিজারে ছিল? ভাঙা গলায় একজন জিজ্ঞেস করলো।
–হ্যাঁ। বললাম।
একেকজন বমি করে দেয় অবস্থা। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। কেউ বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আর এসব শুনতে পারছে না। কারও মাথা ধরলো। মুখ চোখ বিবর্ণ।
(ওহ আর একটা কথা তো বলাই হয়নি। পুরুষগুলো তো চামচে করে খাবার নিতে পারে না নিজের থালায়। পড়ে যায়। কারণ নিয়ে তারা অভ্যস্ত হয়। যখন তারা খেতে বসে, তাদের মা বা তাদের বউ, পাশে দাঁড়িয়ে বেড়ে দেয়। কলকাতার শিক্ষিত ঘরেও এই দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাকে। আমার বাড়িতে এলে, প্রথমেই সোজা বলে দিই, এখানে কেউ খাবার বেড়ে দেবে না আপনাদের, নিজেদের তুলে খেতে হবে। আর আমার বাড়িতে পুরুষের আগে খাওয়া আর মেয়েদের পরে খাওয়ার কুৎসিত নিয়মটা নেই।)
নর্থ বিচ এলাকার আনাচ-কানাচে কবিতা পড়ার অন্য এক আনন্দ আছে। যেন জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লোরেন্স ফারলিংগেটির আমরাই উত্তরসূরি। জ্যাক কেরুয়াক অ্যালিতে ছিল একদিন আমার কবিতা পড়া। কবিতা উৎসবের আয়োজক জ্যাক হিরশম্যান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমি কবিতা পড়বো আমার মাতৃভাষায়, আমেরিকার কোনও কবি আমার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনাবেন। আমাদের বড় অনুষ্ঠানটা হয় সানফ্রান্সিসকোর প্যালেস অব ফাইন আর্টসে। ওই প্যালেসে অডিটোরিয়ামের বাইরে কবিদের কবিতার বইও বিক্রি হয়েছে। আমার বইও ছিল, তবে কবিতার বই নয়, গদ্যের বই। ফাঁক পেয়ে একদিন বিটনিকদের মিউজিয়াম ঘুরে এসেছি। যেন স্বপ্নপুরী। অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে প্যারিসে। জানি না কেন, গিন্সবার্গের চেয়ে বেশি জ্যাক কেরুয়াক আমাকে টানে।
খুন
কেউ কেউ বলছে এত যে ব্লগার লেখক প্রকাশককে কুপিয়ে মারা হচ্ছে দেশে, হাসিনা মোটেও উদ্বিগ্ন নন, খুনীদের ধরা, বিচার করা, এসব তিনি, সত্যি কথা বলতে কী, চান না। মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের অখুশী করলে যদি আবার তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে, কেউ যদি তাকে নাস্তিক ভেবে বসে, তাঁকে যদি গদি হারাতে হয়! হাসিনার নাকি টনক নড়বে তাঁর পুত্রধন জয়কে যদি কুপিয়ে হত্যা করে ইসলামী খুনীরা। তাহলেই নাকি তিনি খুনের বিচার চেয়ে কাঁদবেন। তাহলেই নাকি তিনি ইসলামী খুনীদের শায়েস্তা করবেন।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না। ক্ষমতার লোভ যাকে একবার পেয়ে বসেছে, তার কাছে পুত্রকন্যা স্বামীস্ত্রী মাবাপ সবই তুচ্ছ। জয়কে, যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ না হওয়ার কারণে, অভিজিৎ রায়ের মতো, ওয়াশিকুর বাবুর মতো, অনন্ত বিজয় দাশের মতো, নিলয় নীলের মতো, ফয়সাল আরেফিন দীপনের মতো নৃশংসভাবে, হাসিনার চোখের সামনে, কুপিয়ে হত্যা করলেও হাসিনা ওদের বিচার চাইবেন না, ওদের শাস্তি হোক চাইবেন না। ভয়ে চাইবেন না, চাইলে যদি ইসলামী মৌলবাদী সন্ত্রাসী খুনীরা হাসিনাকে সমর্থন না করে, তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতার লোভটা রক্তপিপাসুদের রক্তের লোভের মতো। ও না হলে তাদের চলে না। গোটা দেশকে রক্তের নদীতে ভাসিয়ে দিতে আপত্তি নেই। পুত্রকন্যাদের রক্ত পান করতে বললেও হয়তো আপত্তি থাকবে না।
গরবাচেভ
২০০৮ সালে বিখ্যাত গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্রোইকার স্থপতি মিখাইল গরবাচেভ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইতালির বোসকো মারেঙ্গোতে, ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যাল ফোরামের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে। আমার বিষয় ছিল নারীর সমানাধিকার। আমি টেবিলের এইপাশে, ওইপাশে বসে মন দিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন গরবাচেভ। কানে অনুবাদের হেডফোন লাগিয়ে শুনেছেন। সাইমালটেনিয়াস অনুবাদ ছিল। বক্তৃতা শেষ হলে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বুড়ো আঙুল উঁচু করলেন। তারপর দেখলাম। উনি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ভাবলাম হয়তো কোনও জরুরি কাজে কোথাও যাচ্ছেন। আশ্চর্য, উনি লম্বা টেবিলটার কিনার দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমার কাছে পোঁছুলেন। আমি তাঁর গন্তব্য! আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে আলিঙ্গন করলেন আমাকে, শুদ্ধ ইংরেজিতে বললেন, খুব ভালো বলেছে, সবার চেয়ে ভালো হয়েছে তোমার বক্তব্য। দি বেস্ট যাকে বলে। আমি বিস্মিত, মুগ্ধ, অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ। এরপর উনি ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। ফিরে মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে রাশান ভাষায় বলতে শুরু করলেন আমি যা বলেছি তা কেন তিনি মনে করেন অতি প্রয়োজনীয়, কেন আমার পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত। প্রায় পনেরো মিনিট বললেন। আমি থ।
গরিবের গ্রেনেড
সেদিন আলোচনা হচ্ছিল কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। প্রসঙ্গ বাংলাদেশ। আজকাল বাংলাদেশের কথা ওঠা মানে পেট্রোল বোমার কথা ওঠা। পেট্রোল বোমায়। এ পর্যন্ত প্রচুর লোক নিহত, প্রচুর আহত। তুমি বাড়ি থেকে বের হলে, কিন্তু তুমি জানো না তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে কি না। তুমি যখন বাইরে, বাসে চড়ছো, গাড়িতে চড়ছো, রাস্তায় হাঁটছো, আচমকা কোনও এক পেট্রোল বোমা উড়ে এসে তোমার গায়ে পড়তে পারে এবং তোমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। তুমি নিশ্চিত নও পেট্রোল বোমা তোমার গায়ে পড়বে না বা তুমি পুড়বে না বা তুমি মরবে না।