এতকাল কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমি কোথায় আছি বা আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছাড়লাম কেন জানতে চাইছে। ভারতের মৌলবাদী তোষণ রাজনীতি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, গরিবের অসহায়তা, সামাজিক অব্যবস্থা, ধর্ম, জাতপাত, পুরুষতন্ত্র, কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে কট্টর জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিক নারীবিরোধীরা আমাকে নোংরা নোংরা গালি দিয়েছে, ধমকে ভারত ছাড়তে বলেছে, বলেছে বাংলাদেশে ফেরত যেতে। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালো চাইলে, অনেক কষ্ট পেতে হয়। রিফুজি, বেগার, ইউ বাংলাদেশি, আমাদের দেশের কোনও ব্যাপারে নাক গলাবি না– এসব গালি অনেক শুনেছি। অনেক ধারণা করে আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে, তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমি এত রাগ করি কেন, কন্যাশিশুদের পুতে ফেলা হলে আমি এত রুখে উঠি কেন, নারী নির্যাতন বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ দেশ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাথি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে। প্রায়ই শুনি এমন হুমকি। একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আরেকদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, কুসংস্কারের ডিপো, উগ্র হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকুলার দলের, তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সরল সমীকরণ, আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু, নিশ্চয়ই ক্রিশ্চান অথবা ইহুদি মৌলবাদীদের বন্ধু। ভারতের উদারপন্থী সেকুলারদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড। শুধু ভারতবর্ষে বধূহত্যা হলেই নয়, সোমালিয়ার মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদন হলেও, ইতালির মেয়েদের গর্ভপাতে বাধা দেওয়া হলেও, সৌদি আরবে মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করা হলেও আমি প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলেই নয়, গুজরাতে বা ফিলিস্তিনে মুসলমানরা, পাকিস্তানে ক্রিশ্চানরা অত্যাচারিত হলেও প্রতিবাদ করি। তা সেকুলারদের অজানা নয়। তারপরও আমাকে ব্রাত্য করতে এরা দ্বিধা করেনি।
এদের বাইরেও মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে। ভারতবর্ষের কত কত শহরে কত কত মানুষ দৌড়ে আসে সই নিতে,, ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি একদিন ফিরে যাবোই। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্খী। ওই ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।
কোরবানির ঈদ
কোরবানির ঈদে গরু ছাগল জবাই করতে করতে হাত পাকে। পরে পাকা হাতে মানুষ জবাইটা ভালো জমে। জবাইয়ের জবের অভাব নেই। সিরিয়ায় গিয়ে আইসিসে যোগ দাও, যত খুশি জবাই করো। তা না হলে বাংলাদেশ তো আছেই। যত ব্লগার বাড়ছে, তত জব বাড়ছে। আল্লাহর নামে ধরো আর কাটো।
এবারের ঈদে মুসলমানের বাচ্চারা সবাই চাপাতি হাতে নেবে। আল্লাহু আকবর বলে গরু ছাগল জবাই করবে। একেকটা জবাইয়ে একেকটা নেকি। আল্লাহ তায়ালা জবাই খুব পছন্দ করেন।
খাওয়াদাওয়া
খাবার দাবারের বেলায়, লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের লোকের গ্রাম্যতা বেশি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একবার দুবন্ধু এলো আমার বাড়িতে, সাতদিন থাকবে। আমি ভাত ডাল শাক সবজি মাছ মাংস রাঁধলাম দুপুরে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বেরোলো। রাতে ফিরে এলে ডিনার খেতে বসেছি একসঙ্গে। ভেটকি মাছ দেখে একজন বললো, কী ব্যাপার, দুপুরে ভেটকি বেঁধেছো, রাতেও ভেটকি বেঁধেছো?
–রাতে রাঁধিনি।
–রাতে রাঁধোনি? কিন্তু এইতো ভেটকি। এটা ভেটকি না?
–হ্যাঁ এটা ভেটকি। কিন্তু এটা দুপুরে যে রেঁধেছিলাম, সেটাই।
–বলছো কী? দুপুরের ভেটকি?
–হ্যাঁ। ভেটকি তো শেষ হয়নি। অনেকটাই ছিল। নতুন করে রাঁধবো কেন? এগুলোই খাবো এখন।
–কিন্তু এগুলো তো দুপুরে খেয়েছি।
–হ্যাঁ, যা বাকি ছিল, সেগুলো ফ্রিজে রেখেছিলাম, মাইক্রোওয়েভে এখন গরম করে দিয়েছি।
-মানে?
–মানে হলো আমি যখন রাঁধি তখন বেশি করেই রাঁধি, যেন পরে আবার খাওয়া যায়।
–কিন্তু আমরা তো বাসি খাবার খাই না।
–বাসি হতে যাবে কেন? ফ্রিজে ছিল।
–ফ্রিজের খাবার তো আমরা খাই না।
–তোমাদের বাড়িতে তো ফ্রিজ আছে। ফ্রিজে খাবার রাখো না? ফ্রিজটা তবে কী কাজে লাগাও?
— জল টল রাখি।
–ব্যস?
–ব্যস।
–আর আমি তো একদিন রান্না করে সব ফ্রিজে তুলে রাখি। একটু একটু করে সাতদিন খাই।
–হোয়াট?
–বলছি, একদিন রান্না করে সাতদিন খাই। কারণ রান্না ছাড়াও তো আরও কাজ আছে। সে সব করতে হবে না? বেলায় বেলায় রাঁধতে হবে কে বললো?
–তাই তো জানি।
–আমি আবার তা জানি না। রেফ্রিজারেটারে আমি খুব ভালো ভাবে খাবার রাখি। নষ্ট হয়না। এখানে গরমকালে তিনদিন খেতে পারি। আর শীতকালে পাঁচদিন। বিদেশে ঠাণ্ডার দেশে তো একদিন রান্না করে আরও বেশিদিন খাই।