সবাই ভাবছে কোপ এবার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতিমাসেই একজনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু লেখক, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও। খুনীদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ওপরের নির্দেশ নেই। শুধু লেখক বা ব্লগারদের নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। তাঁর দোষ, তিনি তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়।
সমাজ যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেও চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে ধর্মান্ধদের ধর্মনুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা অনেকই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন যে ব্লগাররা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়নি। তাহলে কি ধর্মান্ধদের মতো তারাও মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।
অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি একবার কেন, বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।
ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনও একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?
পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
একবিংশ শতাব্দিতে চৌদ্দশ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।
সেক্লার সংগঠনটি তাদের ফাণ্ড রেইজিংএর চিঠিটি বিলি করার পরই সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের সব প্রচার মাধ্যমের কাছে আমি আমেরিকায় এসেছির চেয়ে বড় খবর আমি ভারত ছেড়েছি। আমার ভারত ছাড়ার খবরটা যারাই ছড়িয়েছে, একটু বাড়িবাড়ি করেই ছড়িয়েছে। চিঠিতে লেখাছিল নাআমি তল্পিতল্পানিয়ে জন্মের মতো ভারত ছাড়ছি। ভারত ছেড়ে কোথায় যাবো? এখনও তো ভারতেই পড়ে আছে আমার বাড়িভর্তি বইখাতা, কাপড়চোপড়, অযুত-নিযুত জিনিসপত্তর, পোষা বেড়াল। দিল্লি থেকে বেরিয়েছি ছোট একটা সুটকেসে দুটো জিনস, দুটো শর্টস, আর কটা টিশার্ট নিয়ে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড তো হাতে থাকেই, সে যেখানেই যাই। ভারত ছাড়ার খবরটা নিঃসন্দেহে কোনও সুখবর নয়। আমার কোনও সুখবর কি কখনও কোথাও প্রকাশ হয়েছে। এই যে দীর্ঘ বাইশ বছর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার সংগঠন, নারীবাদী দল আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, একটা সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে নিজের সময়, শ্রম, অর্থকড়ি, বিদ্যেবৃদ্ধি সব ঢেলে দিচ্ছি, এই যে এত সভ্য দেশ থেকে এত সম্মান পেয়েছি, এত পুরস্কার, এত ডক্টরেট উপমহাদেশের কোথাও কেউ কি খবর করেছে? কখনও করেনি, শুধু লিখে গেছে কটা পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি, কটা বিয়ে করেছি, কোন দেশ আমাকে তাড়িয়েছে, কোন রাজ্য আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছে, কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, কত লোক আমার লেখা পছন্দ করে না, আমাকে লক্ষ করে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারা হয়, রাজ্য আমার বই নিষিদ্ধ করে, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল দেখাতে আপত্তি করে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ, বিতর্কিত। শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। বিতর্কিত বিশেষণটি আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলাআমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, সবরকম চেষ্টা করেছে, যেন আমি হয়ে উঠি একটা নিষিদ্ধ নাম, একটা নিষিদ্ধ লেখক।