যে মানুষগুলো আগুনবোমায় মারা গেছে, তাদের বেশির ভাগই গরিব। গরিব মরলে ধনীদের কিছু যায় আসে না। ওই গরিব ছেলে গুলোও কারও না কারও সন্তান। ওই ছেলেগুলোর রোজগারেই হয়তো সংসার চলতো। অনেকেই নির্ভর ছিল ওদের ওপর। ওদের মৃত্যুতে অনেকগুলো পরিবারের সর্বনাশ হয়েছে। আমি ওদের মৃত্যুতে শোক করছি। কোকোর মৃত্যুতে কারও কোনও সর্বনাশ হয়নি। তার মায়ের তো নয়ই। তার মা রাণী মাতা। রাণী মাতা পুত্রের উপার্জনের ওপর নির্ভর করেন না। পুত্ৰ অলে সম্পদ রেখে গেছে যা দিয়ে পুত্রের স্ত্রী সন্তানেরা আমোদে আহ্লাদে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। ওদিকে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে শতাধিক দগ্ধ সন্তান। জ্বলে যাওয়া পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো আর ফিরে পাবে না তাদের আগের জীবন। হয়তো পঙ্গু হয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে হবে। এদের এই পরিণতির জন্য দায়ি কে?দায়ি কোকোর মা। কোকোর মা এভাবেই অসহায় নিরাপরাধ মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পঙ্গু করে মেরে গদি দখল করতে চান। রাণী মাতাদের নিজের জন্য ছাড়া আর কারও জন্য মমতা থাকে না।
খালেদা নিজের আরাম আয়েশ ছাড়া, নিজের পেটের ছেলেদের নষ্ট বানানো ছাড়া, দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেদের বিভ্রান্ত করে, বিপথে নিয়ে বোমাবাজ, ধর্মবাজ বানানো ছাড়া, খুনি আর সন্ত্রাসী বানানো ছাড়া ভালো কী কাজটা করেছেন, শুনি? এদেরই পিঠের ওপর চড়ে তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চান। মানুষকে সভ্য শিক্ষিত করা, সচেতন করা, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্ববান মানুষ করা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা, সবার বাক স্বাধীনতাকে সম্মান করা, সমাজকে দারিদ্র, বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, আর কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা –এসব তার এজেন্ডা নয়। এসবের তিনি বোঝেনই বা কী! কেবল ভাষণ দিতে শিখেছেন। জনগণকে বোকা বানাবার ভাষণ। তাঁর স্বামীও যে কাজটি করতেন।
কোথায় আছি
ভাইরাসের মতো খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। কেন? আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনীরা যারা অভিজিৎ ওয়াশিকুর-অনন্তকে কুপিয়ে মেরেছে, তারা আমাকেও মেরে ফেলবে এই ভয়ে। এতই যদি আমার ভয়, তাহলে ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও কেন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করেছি, আর, কেনই বা বছরের পর বছর ভারতে শুধু থাকিইনি, থাকার জন্য যুদ্ধও করেছি? এ দুটো দেশেই তো জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এ দুটো দেশেই আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, আমার ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে, এ দুটো দেশেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। এতকাল পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত আমি ভয় পেয়ে পালাবো? পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তো কোনওদিনই ছিলাম না। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই জেনেশুনে বাস করেছি, শুধু নির্যাতিত মানুষদের, যাদের কথা লিখি, তাদের পাশে থাকার জন্য। নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কিছু তো করিনি।
আজ একুশ বছর নির্বাসনে। অনেক আগে, যখন আমার খুব নাম ডাক, ইসলামী মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে আমাকে জবাই করবে– খবরটি বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো। আমি সবাইকেই বলেছি, আমাকে নয়, বাংলাদেশের গরিব মেয়েদের সাহায্য করো। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিলো তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আমি বলেছি, ও কাজটি কখনও করো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়ে পরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাবে।
না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। এবার আমার আমেরিকায় আসার কিছু কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ, সেকুলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে বাংলাদেশের নিরীশ্বরবাদী লেখকরা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছে, সে সম্পর্ক বলা, তাদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। আর এখানে যে ফাণ্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মুলত যাবে দেশ থেকে ওই লেখকদের বিদেশে নিয়ে আসা এবং বিদেশে তাদের থাকাখাওয়ার খরচে।
নব্বইয়ের শুরুতে লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীর মিছিল দেখেছি, যে মিছিলে আমার ফাঁসির দাবি উঠতো। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ দেশের প্রতিভাবান লেখকদের জবাই করে, নয়তো পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ বসায়। আমি তাদের পুরোনো শত্রু। ঢাকা থেকে দিল্লি তো খুব দুরে নয়। সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গেই বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করতে পারে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে চাপাতি চালানোর ট্রেনিংটাও হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহরেই করছে। ওদিকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হিটলিস্টে এখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল লেখক, যারা ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, শরিয়ায় নয়, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী। লেখকরা আজ ভয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে, ঘরের কোনে লুকিয়ে রয়েছে, ভয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে, মাথায় হেলমেট পরে বাইরে বেরোচ্ছে, কেউ কেউ শহর থেকে চলে গেছে অচেনা গ্রামে, চেহারা বদলে মিশে গেছে মানুষের ভিড়ে।