রাজনৈতিক শরণার্থীদের উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, এমন একটি দেশে আমি রাজনৈতিক শরণার্থী ছিলাম। কিন্তু সরকারের কাছে থেকে কোনও টাকা পয়সা আমি পাইনি। চাইওনি। বই বিক্রির রয়্যালটি কিছু পেতাম, ওতেই কষ্টেসৃষ্টে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। আজ পর্যন্ত এই যে এত দেশে বাস করেছি, কোনও সরকারের কাছ থেকে কানা কড়ি সাহায্য আমি পাইনি কিন্তু। সরকারি বা বেসরকারি কোনও সংস্থা আগ বাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করতে চায়নি। আমি ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরও কোনও বাড়তি আগ্রহ কেউ দেখায়নি। অথবা ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরই বাড়তি আগ্রহ তো দেখায়ইনি, স্বাভাবিক আগ্রহও দেখায়নি। যদি পশ্চিমের দেশগুলো ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে আমাকে লুফে নিতো। লুফে হয়তো আমাকে নিতো, যদি আমি ইসলামের প্রশংসা করতাম, এবং মুসলিম মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লিখতাম। সালমান রুশদি জনপ্রিয়, কিন্তু ইসলাম বিরোধী লেখা লিখে উনি জনপ্রিয় নন। বাক স্বাধীনতার পক্ষের যে লোকেরা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু রুশদির বইগুলোর মধ্যে সেটানিক ভার্সেসকে খুব উন্নতমানের উপন্যাস বলে মনে করেন না। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চরম ডানপন্থীর সংখ্যা কম, ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রতি তাঁদের প্রবল সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা।
ইওরোপ আর আমেরিকা যদি ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে এত বিপুল পরিমাণ মুসলিম অভিবাসী ওসব দেশে বাস করতে পারতো না। মুসলিমরা যে মানবাধিকার ভোগ করে ইওরোপ আর আমেরিকায়, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও ভোগ করতে পারে না, মুসলিম দেশগুলোতে তো প্রশ্নই ওঠে না। আজ মুসলিমদের মানবাধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁরা পশ্চিমের বুদ্ধিজীবী, পশ্চিমীদের তৈরি হিউমেন রাইটস ওয়াচ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এরকম শত শত সংগঠন। অবৈধ অভিবাসীরা যখন আইনের তাড়া খায়, আশ্রয় নেয় গির্জায় না, এসব গির্জা মুসলিমদের ক্রিশ্চান হওয়ার কোনও শর্ত না দিয়েই আশ্রয় দেয়। এই অভিবাসীদের অনেকেই পায়ের নিচে মাটির ছোঁয়া পেতে না পেতেই পশ্চিমেরই বিরোধিতায় নিজেকে উৎসর্গ করে। পশ্চিমের পুলিশই গাড়ি ঘোড়া সরিয়ে পশ্চিমের বিরোধিতায় ওদের সামিল হতে দেয়, ওদের নিরাপত্তাও একশ ভাগ নিশ্চিত করে। মুসলিমদের জন্য স্বর্গরাজ্য পাশ্চাত্য। বিশ্বাস হয় না? ওদের জিজ্ঞেস করুন। উত্তর আমেরিকার কোনও অঞ্চল থেকে, বা সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যাণ্ড থেকে ওরা সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, জর্দান, মিশর, কুয়েত, কাতার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে বাস করতে চায় কি না। যত বড় ধর্মপ্রাণই হোক না কেন, যতই বিধর্মীদের গালাগালি করুক না কেন, যতই শরিয়া আইনকে শ্রেষ্ঠ আইন বলে বলে রাস্তায় নামুক না কেন, বিধর্মীদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে, কিছুতেই শরিয়া আইনের দেশে, ইসলামের দেশে, মুসলিম প্রধান কোনও দেশে বাস করতে চাইবে না।
কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে
সভ্য পৃথিবীতে নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা হওয়া খুব গৌরবের বিষয়। মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। যাদের পরিচিতি আছে, তাদের দেখার জন্য ভিড় হয়, তাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। পৃথিবীর অসভ্য জায়গাগুলোয় নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনাদের নিয়ে গৌরব করা হয় না। কারণ অসভ্য লোকরা জানেনা, নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা মানে কী। অসভ্য লোকদের কাছে যে মানুষই প্রগতিশীল, যে মানুষই ব্লগ লেখে, যে মানুষই মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে–সে মানুষই নাস্তিক। এবং অসভ্য লোকরা এও বিশ্বাস করে, নাস্তিকদের মেরে ফেলার মতো ভালো কাজ আর হয় না। এই অসভ্য লোকদের সভ্য করার উপায় কী! এদের সভ্য করার জন্য আজ প্রায় তিরিশ বছর আগে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তিরিশ বছর পর দেখলাম, অসভ্যরা আরও অসভ্য হয়েছে। আমার একার লেখালেখি দিয়ে তো আর গোটা দেশের অসভ্যকে সভ্য করা সম্ভব নয়। আরও লেখক যদি লিখতেন, রাজনীতিকরা যদি বলতেন, সরকার যদি পদক্ষেপ নিতেন অসভ্যকে সভ্য করার, মুক্তবুদ্ধির মানুষরা মিলেজুলে পারতেন কিন্তু দেশটাকে বদলে দেবার। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী ভেবে স্বাধীন হলো, আর কোথায় এসে দাঁড়ালো দেশ!
দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পুত্র সজীব জয়, যিনি তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা, ঘোষণা করে দিয়েছেন, নাস্তিকদের পাশে তাঁরা প্রকাশ্যে দাঁড়াবেন না। প্রশ্ন ওঠে, নাস্তিকরা তো দেশের নাগরিক, তাদের পাশে দাঁড়াবেন না তো কাদের পাশে দাঁড়াবেন? উত্তর খুব সহজ। দাঁড়াবেন আস্তিকের পাশে। ভাবছিলাম, নাস্তিক শব্দটি এত ঘৃণিত শব্দ হলো কবে থেকে? সবাই নাস্তিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। এমনকী যে সরকারের দায়িত্ব, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভাষা অঞ্চল বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান ভাবা, সেই সরকারও পক্ষপাতিত্ব করছে।
নির্যাতিত সংখ্যালঘু যুক্তিবাদীদের পাশে দাঁড়াবেন না সরকার। বিনা দোষে তাদের হত্যা করা হলেও তিনি বলবেন না যে হত্যা করাটা অন্যায়। তিনি হত্যাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন না। অন্য যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটছে দেশে, যেমন, পেট্রোল বোমা মেরে যে মানুষগুলোকে মারা হল, সে নিয়ে হাসিনা তো দিব্যি বিবৃতি দিয়েছেন। এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন, আরেক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন না। কী ভয়ংকর এই দেশ! নাস্তিকদের সঙ্গে কোনও ওঠা বসা আছে, সেটা প্রচার হোক, চান না হাসিনা। কারণ তাঁর ভয়, ধর্মান্ধদের ভোট যদি আবার এই ফাঁকে ফসকে যায়।