আমি তাজ্জব।
বললাম, আপনি তো কিছুদিন আগে বলেছেন আমার কবিতা নাকি বালকরা পড়তে পারে, আপনি নন! আপনি কি সত্যিই আমার প্রাপ্তি কবিতাটা পড়েছেন? কিন্তু আপনি তো বালক নন!–
হুমায়ুন আজাদ হাসলেন।
তাঁর ওই হাসিটা বড় অদ্ভুত ছিল। তিনি ওই হাসিটা হাসতেন যখন বাংলাদেশের কবিদের অকবি বলতেন আর ঔপন্যাসিকদের অপন্যাসিক বলতেন। অবশ্য নিজের ব্যাপারে তাঁর আস্থা এবং অহংকার খুব বেশি ছিল।
সেবার আমার বিরুদ্ধে বইমেলায় মিছিল হয়েছিল। আমার বই পোড়ানো হয়েছিল। আমার কোন কবিতা নাকি কাদের ভালো লাগেনি। বাংলা একাডেমির পরিচালক আমাকে বলেছিলেন মেলা থেকে চলে যেতে। পুলিশের একটা ভ্যানে করে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন মেলায় যেন আর না আসি। সব স্টল থেকে আমার কবিতার সব বই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
কবিতার জন্য কী ভয়ংকর ভয়ংকর কাণ্ড ঘটতে পারে!
কবিতা
তিরিশোর্ধ্ব শরীরখানা কাঁপে,
তরবারি কি আছে যুবক তরবারির খাপে।
–এই ছোট্ট কবিতাটি আমার একটি কবিতার বইয়ে ছিল। যে বছর সেই কবিতার বইটি বেরিয়েছে, সে বছর এক পাল যুবক ঢাকার বইমেলায় আমাকে দেখলেই কবিতার লাইনদুটো জোরে জোরে বলতো। যৌনতা নিয়ে কবিতা লিখলে কোনও পুরুষ-কবিকে কি কখনও অপদস্থ হতে হয়েছে কোথাও? আমি শুনিনি।
‘আমার খুব ইচ্ছে দশ পাঁচ টাকায় ছেলে কিনতে ..’– কোনও এক কবিতায় এরকম একটা লাইন ছিল। এক পাল ছেলে এসে আমাকে একদিন বললো, বইমেলার ভেতরেই, আমাকে কিনুন। যতই বলি এ কবিতা, এ কোনও ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নয়, তারা শোনে না। কোনও পুরুষ-কবি যদি তার কোনও কবিতায় লিখতো আমার খুব ইচ্ছে দশ পাঁচ টাকায় মেয়ে কিনতে.., তাহলে কি তাকে হেনস্থা হতে হতো আমার মতো?
আমি যে কবিতাই লিখি, যে প্রবন্ধই লিখি, যে গল্প উপন্যাসই লিখি, লোকে ভাবে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা লিখেছি। কোনও পুরুষ-কবিকে বা লেখককে তার লেখার জন্য কৈফিয়ত এভাবে দিতে হয় না, যেভাবে আমাকে এবং আরও অনেক মেয়ে-কবিকে দিতে হয়। কোনও পুরুষ যদি কোনও কবিতায় এমনও লেখে মেয়েটাকে দলামোচা করে চুমু খাবো, স্তন খামচে ধরবো, দীর্ঘ সঙ্গম করবো, তার পর শেষ রাতের দিকে মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলবো– কেউ কিন্তু এটিকে কবিতা ছাড়া কবির ব্যক্তিগত ঘোষণা বলে ভাববে না। বরং পাঠকরা ওই ভায়োলেন্সের ভেতরেই কাব্য আবিষ্কার করবে, যে কাব্যের সঙ্গে তারা বড় কোনও ইউরোপ বা আমেরিকার কবির কবিতার সাদৃশ্য খুঁজে পাবে।
কল্পনার রাজ্য
প্রচুর লোকের ধারণা, ইসলামের সমালোচনা করলে পশ্চিমের দেশ থেকে বেশ ইনাম, মেলে। মুখগুলো তাদের কল্পনার রাজ্যে বাস করে। সত্য কথা হলো, ইসলামের সমালোচনা করলে তোমার কোথাও ঠাঁই নেই। মুসলিম সন্ত্রাসীরা তোমাকে জবাই করবে, মৌলবাদীরা তোমার মাথার মূল্য ঘোষণা করবে, মুসলিম সরকার তোমাকে জেলে পুরবে, ইওরোপ আমেরিকা তোমাকে অবজ্ঞা করবে। তুমি একা হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ একা। একঘরে। হাতে গোণা কিছু অসহায় নাস্তিক কালে ভদ্রে তোমার খোঁজ নেবে। নাও নিতে পারে।
পশ্চিমের দেশে কদর পায় আদর পায় ফুল পায় ফুল পায় তারা, যারা বলে, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা যে ইসলাম চর্চা করছে, সেটা সহি ইসলাম নয়; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা কোরানের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তা ভুল ব্যাখ্যা। সে কারণে পশ্চিমে মালালা হিরো, কারণ মালালা বলে বেড়ায়, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো। সে কারণে পশ্চিমে তসলিমা জিরো, কারণ তসলিমা বলে বেড়ায়, ইসলামে আর ইসলামী মৌলবাদে কোনও তফাৎ নেই, ফারাক নেই।
পশ্চিমের দেশগুলো মডারেট মুসলমানদের পছন্দ করে, ইসলাম-নিন্দুক নাস্তিকদের মোটেও পছন্দ করে না। বরং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। ওরা মনে করে ইসলামে পরিবর্তন আসতে হবে ভেতর থেকে, অন্য সব ধর্মে যেভাবে এসেছে। বিশ্বাস করে, ইসলামের বাইরে দাঁড়িয়ে নাস্তিকরা চেঁচালে কোনও লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরা, মুসলমান পরিবারের নাস্তিক সন্তানেরা, বাতিলের খাতায়। আমাদের নিয়ে পশ্চিমের রাজনীতিক, দার্শনিক, ভাবুক, বুদ্ধিজীবী, সমাজবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, পূর্ব বিশারদ, ধর্ম বিশারদদের কোনও উৎসাহ নেই।
কল্পনার রাজ্যে বাস করা মুখরা কিন্তু যতদিন বাঁচবে, বলেই যাবে যে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে পশ্চিমের ইনাম পাওয়া যায়। পশ্চিমের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ইসলাম বিরোধী কাউকে ইনাম দিয়ে নিজের সর্বনাশ করবে! আসলে, সত্যিটা হলো, ইসলামের স্তুতি গাইলে শুধু পুবে নয়, পশ্চিমেও ইনাম মেলে।
বেশির ভাগ মুসলমানের ধারণা, আমেরিকা মুসলমান-বিরোধী, কারণ মুসলমানের দেশ আফগানিস্তানে আর ইরাকে বোমা ফেলেছে আমেরিকা, আর সেই বোমায় নিহত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মুসলমান। ইজরাইলকে অস্ত্র শস্ত্র দিচ্ছে আমেরিকা, যে ইজরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মেরে সাফ করে দিচ্ছে। সুতরাং ইসলামের নীতি রীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে বা ইসলামে অবিশ্বাস করলে আমেরিকার ইহুদি নাসারারা ওত পেতে থাকে আলিঙ্গন করার জন্য, হীরে মুক্তোয় ডলারে পাউণ্ডে ইউরোয় ডুবিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে, তা তাদের কে বোঝাবে। আমেরিকার কোনও সরকার কি ইসলামের নিন্দা করেছেন? কোনও সরকার কি কোনও চিহ্নিত ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে দেখা করেছেন? এরকম আমি শুনিনি, দেখিওনি। বরং আমেরিকার সরকার সেইসব মডারেট মুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যাঁরা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টই ঘোর নিশ্চিন্তে বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিছু বিপথগামী লোক শুধু অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমেরিকার কোনও সরকারই কোনও ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে না প্রকাশ্যে না গোপনে কোনও সম্পর্ক রেখেছেন। তাঁরা অনেকেই নিজেরা ধর্মে বিশ্বাস করেন। এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগটা সে কারণেই ভালো।