নিখিল সরকার যে বছর চলে গেলেন, সে বছরই আমি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি। শহরটায় অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি, শুন্য শহরটায়, খা খা করা শহরটায়। এই শহর থেকেও আমাকে তিনবছর পর তাড়িয়ে দেওয়া হল, ঠিক বাংলাদেশ থেকে যেমন তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিখিল সরকার বেঁচে থাকলে প্রতিবাদ করতেন এই অন্যায়ের। একজন লেখক তার লেখালেখির কারণে আর কত যুগ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আঘাত পেতেই থাকবে!
নিখিল সরকার চলে যাওয়ার পর শিবনারায়ণ রায় চলে গেলেন। অম্লান দত্তও গেলেন। আমার জগৎ এখন বড় ফাঁকা। কলকাতা নিশ্চয়ই খুব ফাঁকা এখন। মানুষ আছে, মনীষী নেই। কলকাতায় হয়তো আমাকে এ জীবনে কখনও ঢুকতে দেওয়া হবে না। তবে যেখানেই থাকি পৃথিবীর, নিখিল সরকার মনে রয়ে যাবেন, যতদিন বাঁচি ততদিন। আমি তো ঋণী তাঁর কাছে। আমার মার কাছে আমি ঋণী, বাবার কাছেও ঋণী। নিখিল সরকারের কাছেও। কিছু কিছু ঋণ কখনও শোধ হয় না।
.
শামসুর রাহমান
দেশে থাকাকালীন শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার খুব সখ্য ছিল। এই একটি মানুষই ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে যাঁকে আমার মনে হতো সরল সহজ ভালোমানুষ। হৃদয় দিয়ে লিখতেন। প্রচণ্ড আবেগ ছিল। রেগে গেলে চিৎকার করতেন। দুঃখ পেলে কাঁদতেন। চোখে জল দেখেছি তাঁর। যখন প্যারিসে দেখা হয়েছিল ২০০০ সালে, বিদেয় নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। চলে আসতে আসতে পেছন ফিরে দেখেছিলাম চোখ মুছছেন। দেশে ফিরে গিয়ে আমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ধিক্কার দিয়েছিলেন দেশের সরকার আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের। তিনি হয়তো জানতে ও দেখাই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা।
শামসুর রাহমান নেই। আর কেউ তাঁর মতো অত বড় বৃক্ষ হতে পারেনি। চারদিকে শুধু তৃণ।
.
প্রশান্ত রায়
প্রশান্ত রায় ইস্কুল কলেজের ক্রিম ছাত্র। সব ছেড়েছুঁড়ে নকশাল করতে একসময় মাঠে নেমেছিলেন। গ্রামের এক জোতদারকে প্রাণে মেরে ফেলার আদেশ পান, বড় বড় নকশাল নেতার সে আদেশ তিনি মানতে পারেননি। খুনের রাজনীতি তিনি করবেন। না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কত নকশাল নেতা পচে গেছেন। প্রশান্ত রায় কিন্তু আগের মতোই আছেন। সমাজতন্ত্রে আজও গভীর বিশ্বাস তাঁর। আজও তিনি নিজের আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি। মেরুদণ্ড তেমনই দঢ়। বাড়িতে আজও কোনও রঙিন। টেলিভিশন নেই, কোনও রেফ্রিজারেটর নেই, কোনও এসি নেই, কোনও মাইক্রোওয়েভ নেই, ওয়াশিং মেশিন নেই। গাড়ি তো নেইই। তিনি বলেন, ভারতবর্যের অধিকাংশ লোকের যা নেই, তা আমার থাকবে না। প্রশান্ত রায় আমার লেখা খুব পছন্দ করেন। কারণ, আমার লেখায় মানুষের মধ্যে সমতা আর সমানাধিকারের কথা থাকে। আমার জীবন সংগ্রাম দেখে তিনি অভিভূত। তাই তাঁর পিপলস বুক সোসাইটি থেকে আমার সাত খণ্ড আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। আমরা পরস্পরকে মাঝে মাঝে কমরেড বলেও সম্বোধন করি।
.
শামীম সিকদার
শামীম সিকদারের দাদা সিরাজ সিকদার,সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। সর্বহারা পার্টি অনেকটা নকশাল পার্টির মতো, নিষিদ্ধ ছিল। শেখ মুজিবের আমলে সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলা হয়েছিল। শামীম সিকদার অসাধারণ মানুষ। ছোটবেলায়। সাইকেল চালাতেন। কোনও এক ছেলে তারা ওড়না টান মেরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আর ওড়না পরেননি, সালোয়ার কামিজও পরেননি। সেই থেকে প্যান্ট সার্ট। কে কী বললো না বললো, তার কোনওদিন ধার ধারেননি। যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। ঢাকার আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ভাস্কর্য ডিপার্টমেন্টের মাস্টার হয়েছেন। কিছু পুরুষ-মাস্টার তাঁকে আর্ট কলেজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিলেন একসময়। শামীম সিকদার মোটেও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে ফাইট করেছেন। ফাইটার ছিলেন। প্রয়োজনে পকেটে পিস্তল নিয়ে চলতেন। নাম কিন্তু ওই পুরুষ-মাস্টারদের হয়নি। হয়েছে শামীম সিকদারের। ঢাকা শহরে তাঁর বিশাল বিশাল ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে স্বাপার্জিত স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি। সিগারেট খেতেন। তবে কখনও আড়ালে নয়। সবার সামনে খেতেন। আমি যদি ডাকাবুকো মেয়ে হই, আমার চেয়ে শত গুণ বেশি ডাকাবুকো শামীম সিকদার, এবং আমার আগের জেনারেশনের মেয়ে, যখন সমাজ আরও রক্ষণশীল ছিলো। কৈশোরে শামীম সিকদারের জীবন পড়ে চমকিত হতাম। সেই শামীম সিকদার আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের ফতোয়া ঘোষণা হওয়ার পর ঢাকার রাস্তায় আমার পক্ষে ব্যানার নিয়ে হেঁটেছেন। এবং তাঁরও চেয়ে বড় কথা, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে, যখন আমার বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল আর লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী আমাকে হত্যা করার জন্য সারা দেশে মিছিল মিটিং করেছিলো। সেই দুঃসময়ে যখন বন্ধুরাই সরে গিয়েছিল, এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুধু শুধু বসে বসে দুঃশ্চিন্তা করার বদলে আমাকে কাগজ কলম দিয়েছেন লেখার জন্য, ইজেল, ক্যানভাস আর রং তুলি দিয়েছিলেন ছবি আঁকার জন্য। অনেক রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলতেন। দুমাস অনেকের বাড়িতে আমাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিলো, সবাই একটা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন কদিন থাকতে পারবো তার। কিন্তু শামীম সিকদারই বাঁধেননি সময়, যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শামীম সিকদারই কাউকে ভয় পাননি। পকেটে অস্ত্র নিয়ে তিনি কোর্টেও চলে যেতে চেয়েছিলেন যেদিন জামিনের জন্য আমার যাওয়ার কথা ছিল। এই একটা মানুষ আমার জীবনে আমি দেখেছি, যে মানুষ কাউকে ভয় পাননা, পাছে লোকে কিছু বলের ভয় তো তার কোনওদিন ছিলই না, যে মানুষ মাথা উঁচু করে চিরকাল চলেছেন এবং আমাকেও চলতে শিখিয়েছেন।
কবিতা
সম্ভবত ১৯৯১ অথবা ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। হুমায়ুন আজাদ এলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। বললেন, আপনার যে ইংরেজি অনুবাদের বইটা বেরিয়েছে, এতে আপনার প্রাপ্তি কবিতাটার অনুবাদ নেই কেন? ওই কবিতাটি তো খুব ভালো কবিতা!