.
অম্লান দত্ত
আমি তখন ঢাকায় থাকি। আমার কোনও একটি বই পড়ার পর আমার ঢাকার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অম্লান দত্ত। চিঠিতেই আমাদের অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। তারপর একদিন ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রথম তাঁর বক্তৃতা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হই। অনুষ্ঠানের কোনও বক্তাই অম্লান দত্তের মতো এত অল্প কথায়, এত স্পষ্ট ভাষায়, আসল কথাটা এবং খাঁটি কথাটা এত চমৎকার বলতে পারেননি। আমি সেদিন ছুটে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জীবন ও জগতের অনেক কিছু নিয়ে সেদিন আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মৃদুভাষী ছিলেন, সবার তর্ক বিতর্ক, মত ভিন্নমত শুনতেন, তারপর শেষ মন্তব্যটি করতেন, যেটির পর কারও কোনও কথা বলার দরকার হয় না। যখন নির্বাসন জীবন যাপন করছি, তিনি আমার বার্লিনের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে তখন আরও কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য হয়। তাঁর নীতি এবং আদর্শের সামনে, তাঁর নির্লোভ নির্মোহ জীবনের সামনে, তাঁর সততা এবং সারল্যের সামনে শ্রদ্ধায় বারবার আমি মাথা নত করেছি।
অম্লান দত্তের যে অসাধারণ গুণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হল নিজে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও আমার মতো নাস্তিকের কথা বলার স্বাধীনতার পক্ষে তিনি শুধু মত দেননি, আমাকে সমর্থন করে তিনি লিখেছেন, বলেছেন, সরব হয়েছেন সবখানে। সহিষ্ণুতার পক্ষে তিনি তাঁর মত প্রকাশ করে গেছেন সারা জীবন। পশ্চিমের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই আমি কলকাতা আসার সুযোগ পেয়েছি, প্রতিবারই অম্লান দত্ত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতিবারই আমাদের গল্প হয়েছে দীর্ঘক্ষণ, জীবন আর জগতের গল্প। বিজ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি– যে কোনও বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যেত, যে কোনও জটিল প্রশ্নের সহজ এবং সত্য উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেত। নির্বাসন জীবনে দেশ হারানোর বেদনায় যেন নুয়ে না থাকি; শুধু হা হুতাশ করে, চোখের জল ফেলে সময় নষ্ট না করে যেন আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, আরও জ্ঞান যেন আহরণ করি, বলতেন। আমার সাফল্য তাঁকে আনন্দ দিত, আমার বেদনায় মুষড়ে পড়তেন।
কলকাতায় বাস করার সময় তাঁর বাড়িতে গিয়েছি অনেক। বয়স হয়েছে, একা থাকেন, এ কারণে তাঁকে সাংসারিক কিছু সাহায্য করতে চেয়েছি, তিনি কারও কোনও সাহায্য নেননি। কারও দেওয়া কোনও উপহার তিনি নেননি। জীবনের যেসব জিনিসকে এ যুগে আমরা অতীব প্রয়োজনীয় বলে মনে করি, এবং যেসব ছাড়া বাঁচা অসম্ভব বলে। ভাবি, সেসব ছাড়াই অম্লান দত্ত বেঁচে থাকতেন। তাঁর কোনও অভাববোধ ছিলো না। একবার মানববাদের ওপর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুজন দিল্লিতে গিয়েছিলাম,গান্ধী আশ্রমের অতিথিশালায় ছিলাম, হাড় কাঁপানো শীতে আমি কাবু হয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি আমার দেখভাল করছিলেন। মাঝে মাঝে শিশুর মতো রাগ করতেন। রাগ পড়ে গেলে আবার শিশুর মতোই অমলিন হাসতেন। কলকাতায় আমার সাত নম্বর রাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি প্রায়ই আসতেন। যেদিনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, এসেছেন, একদিন। শুধু নিজেই ছুটে এসেছিলেন আমার আমন্ত্রণ ছাড়াই। হায়দারাবাদে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর দিন। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তাঁর মুখে স্থির হয়ে বসে ছিল। তাঁর বোধহয়। এই ভেবে কষ্ট হত যে, মানুষ তার যুক্তি বুদ্ধি বিবেক বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঁচে আছে, সেটার নাম সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়।
কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর যখনই আমার ওপর কোনও প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান হয়েছে, অম্লান দত্ত গিয়েছেন। বাক স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁকে কখনও ক্লান্ত মনে হয়নি এসবে। বরং যত অসুস্থতাই থাকুক, আদর্শের জন্য তিনি সব ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন, যখন এই কলকাতা শহরেই, অনেক লেখক, কবি, শিল্পী, আমার বিপদ দেখে আলগোছে কেটে পড়েছেন।
.
নিখিল সরকার
একসময় নিখিল সরকার হয়ে উঠেছিলেন একই সঙ্গে আমার মা বাবা ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধব। হোঁচট খেলে তুলে ধরছেন। হাঁটতে সাহায্য করছেন। নির্বাসন অসহ্য লাগলে বলছেন, আমি একা নই, আরও অনেক লেখক নির্বাসন জীবন যাপন করেছেন। আমি যেন হতাশ না হয়ে দুচোখ খুলে জগৎটা দেখি, যেন লেখাপড়ায় মন দিই। উপদেশ দিয়েই যাচ্ছেন, ক্লান্তিহীন। চিঠি লিখছেন যেখানেই ডেরা বাঁধি সেখানেই। আমিও নানান দেশ থেকে ফোন করছি নিখিল সরকারকে। খুঁটিনাটি সবকিছু জানাচ্ছি। কোনও কারণে একটা দিনের জন্যও নিখিলদার সঙ্গে সম্পর্ক আমার নষ্ট হয়নি। নিখিল সরকার আমাকে বই পাঠাতে বলতেন। ভারতে পাওয়া যায় না এমন সব দুষ্প্রাপ্য বই। বইগুলো বিদেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে কিনে পাঠাতাম নিখিলদাকে। ভাবতাম, এসব বই কজন লোক পড়ে আজকাল। এত জ্ঞানের বই! সত্যি বলতে কী, জগতের এত বিষয়ে এত জ্ঞান খুব বেশি মানুষের আমি দেখিনি। এমন পণ্ডিত লোক কজন আছে উপমহাদেশে! যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি বিশাল এক জ্ঞানের সমুদ্র। কত কিছু যে শিখেছি নিখিল সরকারের কাছে! নিখিল সরকার আমার শুধু বন্ধুই ছিলেন না, শিক্ষকও ছিলেন।