ব্লগারদের অনেকে এখন ইওরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ থেকে প্রগতিশীল আর শিক্ষিত-সচেতন মানুষগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। অভিমানে, ক্ষোভে, ভয়ে, হতাশায় দেশের প্রতিভা আজ দেশের বাইরে পাড়ি দিচ্ছে। দেশ কি জানে দেশের কতটুকু সর্বনাশ হচ্ছে দিনদিন?
সরকার কিন্তু চাইলেই এই ক্ষতি রুখতে পারতো। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তো একটিই কাজ, কী করে ছলে বলে কৌশলে গদিতে বসে আরাম করা যায়, লুঠতরাজ করা যায়, ধর্মান্ধদের আরও ধর্মান্ধ করা যায়, অচেতনকে আরও অচেতন করা যায়, অসৎকে আরও অসৎ করা যায়, প্রতারককে আরও বড় প্রতারক বানানো যায়। সরকারের চরিত্র এখনও যেমন ছিল তেমনই। সামান্যও শুধরায়নি কেউ। ধর্ম যেমন ধর্মান্ধ পেযে, দল তেমন দলান্ধ পোষে। রাজনৈতিক দলে এবং ধর্মে আজকাল খুব একটা তফাত দেখি না। ধর্মগুলো দিন দিন রাজনৈতিক হয়ে উঠছে। আর, রাজনৈতিক দলগুলো দিন দিন ধর্মীয় হয়ে উঠছে। ধর্ম টিকিয়ে রাখছে রাজনীতিকে। রাজনীতি টিকিয়ে রাখছে ধর্মকে। চমৎকার বন্ধুত্ব তাদের। শুধু বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।
দেশটির ভবিষ্যত কী মাঝে মাঝে ভাবি। দেশে কারা বাস করবে শেষ অবধি? বেশির ভাগ ধনীরা আমেরিকায় চলে যায়। মধ্যবিত্তরা এশিয়া বাইওরোপের কোনও দেশে। গরিবরা যায় ভারতে। শুধু সেই ধনীরাই দেশে বাস করছে, যারা দেশটাকে প্রাণভরে লুঠ করতে পারছে। শুধু সেই দরিদ্ররাই দেশে বাস করছে, যারা কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না দেশ ছাড়ার। শুধু সেই মধ্যবিত্তরাই দেশে বাস করছে, যারা নিজেরা ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই বেশির ভাগের চিত্র। বাকি যারা দেশকে ভালোবেসে দেশে বাস করে, তাদের সংখ্যাটা ক্রমাগত কমে আসছে, সংখ্যাটা শূন্যে এসে ঠেকলেও আমি অবাক হবো না।
ইওরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পৌঁছে প্রগতিশীল ব্লগাররা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। জানিনা তারা কতদিন আর বাংলায় ব্লগ লিখবে! দেশ থেকে সহস্র মাইল দুরে বসে দেশের কথা লেখার উৎসাহ হয়তো একদিন হারিয়ে ফেলবে। সভ্য দেশগুলো দেশের প্রতিভাবান নাগরিকদের মাথায় তুলে রাখে। বাংলাদেশ তাদের চূড়ান্ত অসম্মান করলো। তাদের হারালো বাংলাদেশ। দেশের সম্পদকে পায়ে ঠেলছে দুর্ভাগা দেশ।
বাংলাদেশকে দেশ বলে ডাকতে আমার আর রুচি হয় না। দেশ মানে আমি নিরাপত্তা বুঝি। যে মাটিতে আমার নিরাপত্তা নেই, সে মাটি আমার দেশ নয়। বাংলাদেশ আসলে কাদের দেশ হয়ে উঠছে? বাংলাদেশ জেনেবুঝে এক পাল অশিক্ষিত, মুখ, নারীবিদ্বেষী, ধর্মান্ধদের দেশ হয়ে উঠছে। আমার লজ্জা হয়। হলে কী হবে, সরকারের তো হয় না।
ওরা আটজন
পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের যে কজন মানুষ আমাকে তাঁদের অফুরন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ এবং সমর্থন দিয়েছেন, আমার সুসময়ে শুধু নয়, আমার দুঃসময়েও পাশে ছিলেন, আছেন, তাঁরা অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, নিখিল সরকার, শামসুর রাহমান, শামীম সিকদার, চূর্ণী গাঙ্গুলী। ওঁরাই আমার আত্মীয়, আমার স্বজন, আমার বন্ধু, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আজ ওঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। ওঁদের মতো মানুষ আরও জন্মাক। পৃথিবীটা সুন্দর হোক আরও।
অন্নদাশংকর রায়
আমাকে খুব ভালোবাসতেন অন্নদাশংকর রায়। আমি যখন বাংলাদেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছি, তখন থেকেই তিনি আমাকে নিয়ে অনেক বলেছেন, অনেক লিখেছেন। একবার তো ঘোষণা করলেন, আমি যেন সঙ্গে পিস্তল রাখি নিজের নিরাপত্তার জন্য।
ইউরোপের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই কলকাতায় যেতাম, চাইতেন সবার আগে তাঁর বাড়িতে যাই। দুপুরের খাবার নিয়ে বসে থাকতেন, একসঙ্গে খাবেন। কত কথা যে বলতেন, কত কথা যে শুনতে চাইতেন। শুনতে চাইতেন বেশি।
একবার তিনি আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটা পুরো রেকর্ড করে নিয়ে এক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছাপিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি তখন বাড়ির বাইরে কোথাও যান না। তাঁকে কোলে করে এনে চেয়ারে বসাতে হয়, কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে হয়। অথচ আশ্চর্য, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়ামে আমার মেয়েবেলার প্রকাশনা উৎসবে সভাপতিত্ব করতে দিব্যি চলে এলেন। আমাকে ভালোবাসেন বলেই তিনি অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়েছিলেন।
ওখানেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়না, কিন্তু তসলিমার বেলায় মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি..। আমি তাঁর এই স্নেহ ভালোবাসার মর্যাদা ঠিক ঠিক দিতে পারিনি। বিদেশ থেকে কলকাতার কত কারও জন্য কত উপহার নিয়ে আসতাম। প্রতিবার ভুলে যেতাম অন্নদাশংকর রায়ের কথা। আমি কলকাতায় এসেছি শুনেই তিনি খবর পাঠাতেন, একবার যেন দেখা করতে যাই। অপেক্ষা করতেন আমার জন্য। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়তাম তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। একবার খুব অল্প সময়ের জন্য তাঁর বাড়ি গেলাম, কথা দিয়ে এলাম দুদিন পর যাবো। দুদিন পর এলো। যথারীতি ভুলে গেলাম যেতে। তার পরদিন গিয়ে দেখি তিনি অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন বিছানায়। আমি যে এসেছি দেখতে পেলেন না।