ইমাম ছাড়াও অন্য পুরুষরা অহরহই ধর্ষণ করছে। ইমাম জাতও পুরুষের জাত। কিন্তু ইমামের গুরুত্বটা অনেক। ইমামকে দেখে শেখে পুরুষরা। ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে পুরুষরা নামাজ পড়ে। ইমামের কথা এবং কাজকে তারা মান্য করে, ইমামের উপদেশ পরামর্শ মতো জীবন যাপন করে। সুতরাং ইমাম যদি ধর্ষক হয়, তবে সমাজের পুরুষরা তার কাছ থেকে ধর্ষক হওয়ার প্রেরণা পাবে। সুতরাং ইমামদের চরিত্র নষ্ট হলে চলবে না। ইমামদের গতিবিধি নজর রাখার ব্যবস্থা না হলে সমূহ বিপদ।
দেশে দিন দিন দুঃসংবাদের পাহাড় গড়ে উঠছে। কী ভালোই না হতো যদি দেশটি থেকে ধর্ষণের খবর না আসতো। সেদিন একটা গারো মেয়েকে গণধর্ষণ করা হলো বাংলাদেশে। বাসের ভেতর। ভারত থেকে ভালো অনেক কিছু তো শেখার আছে। শিখলো শিখলো গণধর্ষণটাই শিখলো? যে লোকগুলো মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে, ওদের জিজ্ঞেস করুন, ওরা ধর্মে বিশ্বাস করে কি না, সবাই, আমি নিশ্চিত, বলবে, করে। আল্লাহকে মানে? বলবে, মানে। তোমরা কি নাস্তিক? জিজ্ঞেস করুন। ওরা খুঁসে উঠবে। এত বড় অসম্মান। আমাদের নাস্তিক বললো? ওরা তীব্র প্রতিবাদ করবে, বলবে যে ওরা আস্তিক। মাঝে মাঝে মনে হয়, নাস্তিক হওয়ার পথই বোধহয় সহিষ্ণ হওয়ার, উদার হওয়ার, মানবিক হওয়ার সঠিক পথ।
ও আমার দেশের মাটি
একসময় এই গানটি বেশ গাইতাম, ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। এই গানগুলো আর গাই না আমি। কারণ গানগুলোর কথা এখন আমি আর বিশ্বাস করি না। কথাগুলোয় প্রচুর ভুল। শুধু আবেগ দিয়ে মিথ্যেকে সত্য করা যায় না। সত্যকেও মিথ্যে করা যায় না। বাংলাদেশ সকল দেশের সেরা দেশ নয়। বরং বার বার প্রমাণ করছে পৃথিবীর আর সব দেশের চেয়ে প্রায় সবদিক থেকেই পিছিয়ে আছে দেশটি। এই দেশটি নিয়ে কোনও শিক্ষিত-সচেতন মানুষ গর্ব করবে না। দেশটিতে দারিদ্র, প্রতারণা, অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য, নির্যাতন একেবারে রমরমা। তাই তো দেখি বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল থেকে ৯৭৯ জন লোক ভারতে যেতে চাইছে, আর ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল থেকে কেউ বাংলাদেশে ফিরতে চাইছে না। এই ঘটনা থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি বাংলাদেশের প্রতি কারও আশা নেই, কারও সত্যিকার ভালোবাসা নেই, কেউ বিশ্বাস করে না দেশটিকে, কারও সামান্য আস্থা নেই দেশটির ওপর। এই দেশটি থেকে বছর বছর অমুসলিমরা চলে যাচ্ছে নিরাপদ কোনও দেশে। হিন্দুর সংখ্যা কমতে কমতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা এত তীব্র যে কেউ দেশটিতে আর বাস করতে চায় না। সুযোগ পেলে সবাই চলে যেতে যায় দেশের বাইরে। আজ যদি সীমান্তে কোনও কাঁটাতারের বেড়া না থাকতো, বা দেশ থেকে ভিসার নিয়ম উঠে যেতো, আমার বিশ্বাস দেশসুদ্ধ লোক দেশ ছাড়তো। দেশটা শুকনো পড়ে থাকতো সুদূর মরুভূমির মতো।
ভারতভাগের সময় পাকিস্তান থেকে হিন্দু যত গেছে ভারতে, ভারত থেকে মুসলমান তত আসেনি পাকিস্তানে। ইস্কুল কলেজ একরকম খালি হয়ে গিয়েছিল দেশভাগের পর। শিক্ষক নেই। বেশির ভাগ ছাত্র নেই। হিন্দুরা ছিল মুসলমানদের চেয়ে বরাবরাই বেশি শিক্ষিত। তাদের অধিকাংশই দেশ ছাড়ার পর মুখতার ভারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। দেশভাগের পর মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যদিও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমানকে এক জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তারপরও বারবার দাঙ্গা লেগেছে দেশে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা বার বার দেশত্যাগ করেছে। পাকিস্তানকে হঠিয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল একাত্তরে, সেটি নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আবার। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে কয়েক বছরে। দেশত্যাগ শুরু হয়েছে আবার। সব আশার প্রাচীর চুরচুর করে ভেঙে পড়েছে। দেশে অরাজকতা এত তীব্র যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে আজকাল শুধু হিন্দু যাচ্ছে না, মুসলমানও যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, আজ বাংলাদেশের মুসলমানের ভিড়। ভারতবর্ষের প্রায় সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে তারা। শুধু সামান্য অন্নবস্ত্রবাসস্থানের জন্য, জীবনের সামান্য নিরাপত্তার জন্য, সামান্য স্বস্তির জন্য ভারতে বসত গড়েছে। ভারতেই শুধু নয়, বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় যে কোনও দেশেই, এমন কী অন্য কোনও গরিব দেশেও তাদের বাস করতে আপত্তি নেই। ইওরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমানোর জন্য সবাই এক পায়ে খাড়া। আগে গলা কাটা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, জীবনের বিশাল ঝুঁকি নিয়ে। হলেও, মানুষ দেশ ছাড়তো। দেশে থেকে কিচ্ছু হবে না, দেশে কিছু নেই সেই যে কতকাল আগে বলা শুরু করেছিল মানুষ, এখনও বলছে। দেশ নিয়ে হতাশার শেষ আজও হয়নি। আর সব দুর্যোগই কাটে, নড়বড়ে দেশও শক্ত পায়ে দাঁড়াতে শেখে, বাংলাদেশই শুধু পারে না, বাংলাদেশের দুর্যোগই শুধু কাটে না।
কিছুদিন আগে দেশের প্রগতিশীল ব্লগারদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। প্রত্যেকে, হ্যাঁ প্রত্যেকে দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমার লেখালেখির জন্য ফতোয়া জারি করেছিল ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা। আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছিল ওরা। লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিল হতো আমার বিরুদ্ধে, লং মার্চ হতো। সারা শহরে এক লক্ষ বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেবে বলে সাপুড়েরাও আমার ফাঁসির দাবিতে সাপ হাতে নিয়ে মিছিল করেছে। সুইসাইড স্কোয়াড় গঠন করা হয়েছিল আমাকে হত্যা করার জন্য। সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। অন্ধকারে আত্মগোপন করে থাকতে আমি বাধ্য হয়েছি। ওই ভয়াবহ দুঃসময়েও আমি দেশ ত্যাগ করার মতো দুঃস্বপ্ন দেখিনি। আর দেশের দুঃসময় এখন কত ভয়ংকর, কত বীভৎস হলে সব ব্লগাররা বাঁচার জন্য দেশ ত্যাগ করতে চাইছে! এই দুঃসময় অনুমান করাও বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব নয়।