মেয়েরা যদি পুরুষের শেখানো ভাষায় না লেখে, কী বলবে-কতটুকু বলবে কোথায় সীমা টানবে— এই রুলটা না মানে, তবে পুরুষতান্ত্রিক লোকদের বড় রাগ হয়। এই সমাজে যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের গায়ে রাগ না ধরাতে পারে, যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের কাছ থেকে নষ্ট, স্লাট, বেশ্যা ইত্যাদি আখ্যা না পায় — সেই মেয়েদের নিয়ে খুব বেশি আশা করার নেই।
নারীবিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস যারা করে না, যারা অবাধ্য, যারা নিয়ম ভাঙে, তারাই সমাজ পাল্টায়। তারাই বিবর্তন ঘটায়। আমি তাদেরই স্যালুট করি।
৮. রূপী কৌরের ঋতুস্রাবের রক্তমাখা ছবিটা দুর্দান্ত। দিপিকা পাড়ুকোনের মাই চয়েজ ভিডিওটাও অসাধারণ। মেয়েরা শেষ অবধি কথা বলছে। যাদবপুরেও মেয়েরা জেগে উঠেছে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই জাগরণটার ভীষণ প্রয়োজন। মানুষ-প্রজাতির এক দল তার নিজের প্রজাতিকে কেবল ভিন্ন লিঙ্গ হওয়ার কারণে নির্যাতন করছে, বঞ্চিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, হেনস্থা করছে, এবং হাজার হাজার বছর ধরে এটা চলছে; গায়ের জোরে, পেশির জোরে, অশিক্ষা আর কুশিক্ষার জোরে চলছে –ভাবলে শিউরে উঠি। আরও হাজার বছর আগেই উচিত ছিল এই জাগরণের। নারী পুরুষকে এক মিছিলে হাঁটতে হবে সমানাধিকারের দাবিতে। আমরা পেশি দিয়ে সমাজ চালাই না, বুদ্ধি দিয়ে চালাই। সুতরাং যার পেশির জোর বেশি, সে বেশি মুল্যবান, যার পেশির জোর কম, সে কম মুল্যবান–এভাবে ভাবাটা হাস্যকর। নারী তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে নারীর চেয়ে পুরুষই বেশি উপকৃত হবে। সঙ্গিনী হিসেবে শিক্ষিত স্বনির্ভর সমকক্ষ নারীকে পাওয়া আর দাসি বাঁদিকে পাওয়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘোচানোর দায় নারীর একার নয়। এ বৈষম্য ঘোচানোর দায় সব মানুষের। যে মানুষেরা সচেতন, যে মানুষেরা চেঁচালে, চেষ্টা করলে বৈষম্য ঘোচে, দায়িত্বটা তাদেরই নিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য যতদিন থাকবে ততদিন মানবজাতিকে সভ্য জাতি বলার কোনও যুক্তি নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীবিরোধী পুরুষরা পুরুষরক্ষা সংগঠন, পুরুষাধিকার সংস্থা ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। এসব সংগঠন নারীবিরোধিতা, নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা প্রচার করতে সারাক্ষণই ব্যস্ত। আমার খুব ভালো লাগে, যখন দেখি পুরুষরা নারীর অধিকারের পক্ষে মিছিলে নামছে। এই পুরুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু এই সংখ্যাটা বাড়ুক, চাই। এই সংখ্যাটা বাড়লেই সমাজে পরিবর্তন আসবে। যে পুরুষরা নারীকে ধর্ষণ করে, খুন করে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক আজ থেকে কোনও নারীকে তারা ধর্ষণ করবে না বা খুন করবে না। যে পুরুষরা নারী নির্যাতনে বেশ হাত পাকিয়েছে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক নারী নির্যাতন আর করবে না। যে পুরুষেরা যৌন হেনস্থা করে, তারা আজ থেকে বন্ধ করুক যৌন হেনস্থা। আজ থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ, নিজেদের সন্তান-পালন, নিজেরা মিলেজুল করুক। আজ থেকে বাইরের দুনিয়ার কাজ নারী-পুরুষ উভয়ে করুক, স্বনির্ভর আর পরনির্ভরের সংসারের বদলে সংসার হয়ে উঠুক দুজন স্বনির্ভর মানুষের সংসার। আজ থেকে নারী আর পুরুষের সমতা আসুক সংবিধানে, রাষ্ট্রে, আইনে, সমাজে, পরিবারে, অফিসে, আদালতে, রাস্তা-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে, লঞ্চে সর্বত্র। নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সত্যিকারের বন্ধুতা। প্রভু-দাসির সম্পর্কটা, উঁচু নিচুর সম্পর্কটা সম্পূর্ণ নির্মূল হোক।
একটি মৃত্যু
কত ছেলেকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কত ছেলে মার খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে। কত মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। কত মেয়েকে প্রতিদিন স্বামীর অত্যাচার সইতে হয়! তাদের খবর কজন রাখে!
আমরা তো জানিই যে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ। মানুষের এই হত্যাযজ্ঞ কি কেউ থামাতে পেরেছে আজ অবধি? মানুষ তো মানুষকে পেটাচ্ছে, চিল ছুড়ছে, হয়রানি করছে, এসব দেখে অভ্যস্ত, এসব নৃশংসতা দেখে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে যায়, সংসার করে। ফুটপাতের মৃতদেহ ডিঙিয়ে সকালে আপিসের দিকে হাঁটে। কারও সময় নেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকার, অথবা প্রতিবাদ করার। মানুষ দল বেঁধে দেখে যখন কোনও মেয়েকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। মানুষ হাততালি দেয় যখন কাউকে উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে হাঁটানো হয়। এ কি মানুষের আজকের স্বভাব? আদিকালে মানুষকে শুলে চড়ানো, ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো, ক্রশবিদ্ধ করা– সবই জনতার সামনে হতো। জনতা হাততালি দিত, হাসতো, ঘৃণা ছুঁড়ে দিতো অত্যাচারিত নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। এ আমাদের মানুষজাতির বৈশিষ্ট্য।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক গ্রামে রাজন নামের একটা গরিব ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কিছু লোক। পেটানোর দৃশ্য অনেকে দেখেছে। দেখেছে আর হেসেছে। পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও ওরা ফেসবুকেও দিয়েছে। এই যে দিন-দুপুরে একটা ছেলেকে মেরে ফেলা হলো, কেউ কি বাঁচাতে এসেছিল? কেউ আসেনি। রাজন নাকি কী চুরি করেছিল, তাই পেটানো হয়েছিল। আমি কিন্তু একথা বলতে চাইছি না। যে রাজনকে গরিব করেছে এই সমাজ, দোষটা সমাজের। চুরি না হয় করেছে রাজন, তাই বলে তাকে মেরে ফেলতে হবে?। আমি শুধু বলতে চাইছি, মানুষ নামক জাতটার জন্য বর্বরতা নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা হিংস্রতা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুর্বলকে মেরে ফেলে। মানুষের মতো কাজই করেছে ওরা। সবল-মানুষ দুর্বল-মানুষকে মারে। ধনী-মানুষ গরিব মানুষকে মারে। পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষকে মারে। নানা কায়দায় মানুষ মানুষকে মারে। প্রতিদিন মারে। কেবল রক্ত গড়ালেই আর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হলেই কি মৃত্যু ঘটে? অনেকে মার খেতে খেতে মৃতবৎ বেঁচে থাকে।