গালি যত ইচ্ছে দাও। কিন্তু ভায়োলেন্স বন্ধ করো। আইডিওলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহিডিওলজি দিয়েই হতে হবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাত ধর্মের চিরকালের। বিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞান যে মানে না, তাদের ধারালো ছুরি শানিয়ে কোপাতে যায় না। কিন্তু ধার্মিকরা, ধর্ম যে মানে না তাদের কোপাতে যায়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে। পৃথিবীতে মুসলমান ছাড়া আর কোনও সম্প্রদায় নেই যারা নিজেদের কোপাচ্ছে, জবাই করছে, বোমা ছুড়ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে।
অভিজিৎ
কেন অভিজিৎ গেল দেশে! সম্ভবত ফেসবুকে দেওয়া হুমকিকে বড় কোনও হুমকি বলে মনে করেনি। আমাকেও তো ফেসবুকে-টুইটারে ইমেইলে হত্যার হুমকি দেয় লোকেরা। আমি তো গা করি না। তাঁর বাবাও বলেছিল দেশে না যেতে দেশে না যেতে তো আমাকেও কত লোকে বলে, তারপরও তো আমি মনে করি, যে করেই হোক দেশে যাবোই আমি। অভিজিৎএর জায়গায় আমি হলে আমি হয়তো ঠিক তাই করতাম, অভিজিৎ যা করেছে। আমাকে যদি দেশে ঢুকতে দিত সরকার, বইমেলায় আমি ঠিক ঠিক যেতাম, বিশেষ করে সে বইমেলায় যদি আমার দুটো নতুন বই বের হয়ে থাকে। একজন লেখকের জন্য বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময় করা যে কী ভীষণ আনন্দের, তা সব লেখকই জানেন।
এখন আমি জানি, দেশে যদি বাস করতাম আমি, বা দেশে যদি কখনও বেড়াতেই যেতাম, আমাকে ঠিক ওভাবে অনেক আগেই কুপিয়ে মেরে ফেলতো ওরা, যেভাবে অভিজিৎকে মেরেছে। আশি নব্বইএর দশকে বড় বড় মুফতি, ইমাম, মাদ্রাসায় পড়া মাতব্বর গোছের লোকেরা ফতোয়া দিত, মানুষের মাথার দাম ঘোষণা করতো। লক্ষ লোক মিছিল করতো, লং মার্চ করতো। আজকাল ফেসবুকে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যাকে হুমকি দেয়, তাকে ঠিক ঠিক একদিন পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারে। চোখে পড়ার মতো এই বদলটাই সম্ভবত বাংলাদেশে গত কবছরে হয়েছে।
অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি দেশে ফিরতাম। আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।
ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখেছি, একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, মৌলবাদের লম্ফ ঝম্ফ দেখিনি। আশির দশকে ধর্মের এবং ধর্মের মহাপুরুষদের নিন্দা করে আমার যেসব কলাম ছাপা হত বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি আঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে –তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে রাজপথে নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওদের এত বাড় বাড়তো না। কী করে ভুলবো নব্বইয়ের শুরুর দিকে কী ঘটেছিল। আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশ জুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে–কোনও লেখকের ওপর দেশজুড়ে অমন ভয়ংকর দুর্যোগ এর আগে আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার নাম উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? নাস্তিক নারীবাদীর বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর হয়ে গেল, দেশে আজও পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। প্রতিবাদ একা আমিই নিরলস করে গেছি। আজও করি। নিজের জন্য নয়, দেশটার জন্য করি। কারণ আমি জানি, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়টা বড় হতে হতে অজগরের মতো হয়ে যায় আর যাকে সামনে পায়। তাকেই গিলে খায়।
মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের তথাকথিত প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত দুদশক ধরে মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো চুপচাপ দেখে গেছে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই আদালতে গিয়ে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি। মৌলবাদের উত্থানের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ তাদের মৌনতা এবং আপোস। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং ওদের খুশি করার জন্য, ওদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা! মৌলবাদীরা কি আর তারপর হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থেকেছে? তারা যা ইচ্ছে তাই করার সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। তাই মহাউৎসাহে নেমে পড়লো একের পর এক বাক স্বাধীনতা হরণে। মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর ক্রমাগত আঘাত আসতে লাগলো, আসলে লাগলো খুনের হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।