ভাবছি মসুলের মানুষের কথা। ঈদের নামাজ পড়তে গেলে তাদের আজ খুন হয়ে যেতে হবে। ধর্মকর্ম করার অধিকারও মানবাধিকারের অংশ। আমি নিজে ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকারের জন্য আমি লড়ি। মসুলের মানুষ যদি ঈদের নামাজ পড়তে চায়, তবে সেই অধিকার তাদের থাকা উচিত। একই রকম কারও কারও যদি ধর্মে বিশ্বাস না করতে ইচ্ছে হয়, ধর্মের সমালোচনা করতে ইচ্ছে হয়, সেই অধিকারও তাদের থাকা উচিত। কিন্তু জোর করে ধর্মকর্ম করতে বাধা দেওয়া আর ধর্মের সমালোচনা করতে বাধা দেওয়া– দুটোরই বিরুদ্ধে আমি। স্বাধীনতায়। বিশ্বাস করলে বাক স্বাধীনতা আর ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা দুটোতেই বিশ্বাস করতে হয়। স্বাধীনতায় আমি গভীরভাবে এবং বড় অকপটভাবে বিশ্বাস করি। স্বাধীনতাহীন জীবন বড় দুঃসহ।
মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবীর এত সহস্র কোটি মুসলিম আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কেন করে না? কেন অনেকে সব জেনেশুনে আইসিসে যোগ দেয়? আইসিসের আদর্শে তবে কি তারা সত্যিই বিশ্বাস করে নাকি মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করার আর ধারলো ছোরা দিয়ে মানুষের মুণ্ডু কাটার আনন্দ তারা উপভোগ করতে চায়, নাকি অল্প বয়সী মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করার আর অগুনতি যৌন দাসীকে ভোগ করার মজা পেতে চায়? এছাড়া যে আইসিস নামাজ নিষিদ্ধ করে, যে আইসিস মসজিদ গুঁড়ো করে, ইউনুস নবীর কবর ভাঙে, কাবা ভেঙে ফেলার স্বপ্ন দেখে, ইসলামের এতকালের পবিত্র সৌধ যারা উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের প্রতি মুসলিম যুব সমাজের এত কেন আকর্ষণ?
আইসিসকে দমানোর চেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বড় শক্তি সৌদী আরব নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থেই আইসিসকে নিশ্চিহ্ন করবে। আবার সৌদি আরবের ভেতরের অনেক খাঁটি ইসলামপন্থীদের টাকায় আইসিস শক্তশালী হতে থাকবে। আর আমরা দুর থেকে দেখতে থাকবো হত্যাযজ্ঞ। নিরীহ মানুষ বলি হতে থাকবে আর আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবো আর অপেক্ষা করতে থাকবো মানুষের শুভবুদ্ধির। শুভবুদ্ধি সবার উদয় হয় না, হবেও না। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা ফুরোবে না।
অপেক্ষা ছাড়া নিরীহ মানুষের আছেই বা কী।
তবে এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, এক আইসিস গেলে আরও আইসিস আসবে। আইসিস তাদের নৃশংসতা দেখিয়েছে পৃথিবীকে। এই নৃশংসার চর্চা আরও বহুকাল চলবে, যতদিন না মানুষ ধর্মকে গৌণ করতে পারে আর মানবতাকে মুখ্য করতে পারে। মানবতাকে মুখ্য করার শিক্ষাটা ধর্মশিক্ষার বাইরের শিক্ষা, সভ্যতার, সমতার, সমানাধিকারের শিক্ষা। আইসিস তৈরি হওয়া সহজ, আইসিসের বিপরীত আদর্শে মানুষকে দিক্ষিত করা সহজ নয়। আইসিসের আদর্শে খুন ধর্ষণ লুটতরাজ আর ভায়োলেন্স। আইসিসের বিপরীত আদর্শে আছে শান্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনওকালেই কোনও গোষ্ঠীতেই সহজ ছিল না, সহজ নয়।
এই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।
উইকিপিডিয়া
আমার উইকিপিডিয়া পেইজে লেখে কারা? সেই আদিকালে আমার ওপর একটা পেইজ খোলা হয়েছিল। কে খুলেছিল কে জানে। আজগুবি তথ্য থাকতো। ওসব তথ্য চোখে পড়লে দ্রুত সরিয়ে নিতাম চোখ। অনেক বছর পর নিজে একবার সঠিক তথ্য দিয়ে উইকিপিডিয়ার ভুল সংশোধন করলাম। করলে কী হবে, পরদিনই আবার সঠিক তথ্য পুরোটাই মুছে দিয়ে ভুল তথ্য এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। আবারও সংশোধন করলাম। ওই একই অবস্থা। এরপর তৃতীয় বার সংশোধন করতে গেলে উইকিপিডিয়ার সিকিউরিটি গার্ড ফার্ড এসে আমাকে রীতিমত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। সম্ভবত আমার নামটাই ওদের খাতায় সাইবার ক্রিমিনাল হিসেবে লেখা হয়ে গেছে। উইকিপিডিয়াকে আমি একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম এই যে আমার সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বসে আছো অথচ আমাকে দিচ্ছে না সংশোধন করতে! এ কেমন বিচার! খুব তো ভাব ধরছো সব জানো সব বোঝো, তবে আমাকে চিনতে পারছো না কেন! কেন জানো না যে যাকে নিয়ে এই পেইজ, সে স্বয়ং আমি! নাহ, আমার কথা কারও কানে পৌঁছয়নি। এরপর আশা ছেড়ে দিয়েছি। যারা আমার সম্পর্কে লেখে উইকিপিডিয়াতে, তারা বেশির ভাগ না জেনে অথবা ভুল জেনে লেখে। ভুলভাল খবর যেসব বেরোয় পত্রপত্রিকায়, ওগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে লেখে। যার যা খুশি লেখে লিখুক। ও আমি দেখবোও না, পড়বোও না, শুনবোও না। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি সাত খণ্ডে আমার আত্মজীবনী লিখেছি। এত বড় আত্মজীবনী খুব কম লেখকই লিখেছেন। আত্মজীবনীতে পুরো জীবনের কথাই লিখেছি আমি, অর্ধেক জীবনের নয়। কিছু গোপন করিনি। কিছু মিথ্যে লিখিনি। এই যে এতকাল ধরে আমার আত্মজীবনী পড়ছে লোকে, বছরের পর বছর ধরে ওসব ছাপা হচ্ছে, ফুরোচ্ছে, আবার ছাপা হচ্ছে। এসবের পাঠকেরা কোথায়? তারা কেন উইকিপিডিয়ার ভুল সংশোধন করছে না? তারা তো অন্তত জানে আমার জীবনের খুঁটিনাটি সব!
আজ হঠাৎ বাংলা উইকিপিডিয়ায় চোখ পড়লো। এ তো আরও অখাদ্য। চোখ বুলিয়ে দেখি আমার নাম নাকি ছিল নাসরিন জাহান তসলিমা, আমি নাকি কবিতা টবিতা লেখার সময় তসলিমা নাসরিন নাম দিয়েছি নিজের। আমার মা নাকি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। তারপর আমার হরেক রকম স্বামীর প্রসঙ্গ তো আছেই।
নকলবাজদের তো অভাব নেই। তারা কোথায়? তারা তো আমার ওয়েবসাইট, ফ্রিথট ব্লগইত্যাদি থেকেও আমার সম্পর্কে সঠিক তথ্য কপি পেস্ট করে উইকিপিড়িয়ায় দিতে পারে। নাকি সঠিক তথ্যে মজা নেই। মজা ভুল আর মিথ্যে তথ্যে? আমার মনে হয়, আমার সম্পর্কে এতকাল ধরে মৌলবাদী আর নারীবিদ্বেষী লোকেরা যে সব অপপ্রচার চালিয়েছে, ওগুলো সত্য তথ্য বলে একরকম প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছে। মানুষের মস্তিষ্কেই ঢুকে বসে আছে ওসব। মানুষের মস্তিষ্ক এমন এক জিনিস, যেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া সহজ, বের করা মোটেও সহজ নয়।
উপহার
বাংলাদেশের অবস্থা বোঝার জন্য বোধহয় এই ইনফোটুকুই যথেষ্ট। কী ঘটেছে। বলি। আজ সকালে এক তোড়া গোলাপ আর একটা চকলেট কেক এলো কুরিয়ারে। বিকেলে আসছে একটা দেওয়াল ঘড়ি। পাঠিয়েছে বাংলাদেশ থেকে আমার ছোটভাই মতো একজন। ফেসবুকেও আছে সে। একটু আগে ফোন করলো। আমি ধন্যবাদ জানালাম। বললো ঢাকা থেকে অনলাইনে অর্ডার করে এসব সে আমার জন্মদিনে উপহার পাঠিয়েছে।