আমার ভয় হচ্ছে, যুক্তিবাদী মুক্তমনা লেখকদের আবার ছুট্টি হয়ে যাচ্ছে না তো! দেশে কমপিউটার বন্ধ। বিদেশে পালিয়ে এসে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। লেখালেখি হয়তো আর হবে না অনেকের। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করার কাজে কেউ আর হয়তো আগের মতো এগিয়ে আসবে না। সবাই তো আর আমার মতো নয়। যুগ যুগ ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভাসমান জীবন কাটিয়ে হলেও, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে, ঘাড়ধাক্কা, অন্যায়, অপমান, নিষেধাজ্ঞা, ঘৃণা সয়েও মানবাধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, বাক স্বাধীনতার জন্য, সহিষ্ণুতার জন্য, সমতার জন্য, যা হয় হোক, লড়াই করে যাবে!
সমাজ যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেও চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে ধর্মান্ধদের অনুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি, বিশেষ করে ধর্মানুভূতিতে। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস-বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা অনেকই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন যে ওরা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়নি। তাহলে কি তারাও ধর্মান্ধদের মতো মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।
এমন কে আছে যার কোনও অনুভূতিতে আজ অবধি কোনও আঘাত লাগেনি। অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি একবার কেন, বাবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।
ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞজ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনও একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?
ধর্মানুভূতি নিয়ে রাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এখন। এর সমাধান কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত না করা নয়। বরং উল্টো। ধর্মানুভূতিতে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে হবে। মুহুর্মুহু আঘাতের ফলেই এই আঘাত গা সওয়া হবে। ধর্মানুভূতিকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসা এক্ষুণি বন্ধ না করলে অসং ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজের যেটুকু বাকি আছে ধ্বংস হওয়ার সেটুকুও ধ্বংস করবে।
পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্মব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ইসলামি ইউকুইজেশন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে ওরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেনি, এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত, ওরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাত ধর্মের চিরকালের। বিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞান যে মানে না, তাদের ধারালো ছুরি শানিয়ে কোপাতে যায় না। কিন্তু ধার্মিকরা, ধর্ম যে মানে না তাদের কোপাতে যায়। এ মহানবীর আদর্শ। তিনি এভাবে কুপিয়ে বিধর্মী মারতেন, অবিশ্বাসীদের মারতেন। তাঁর অনুসারীদের এভাবেই মারতে শিখিয়ে গেছেন তিনি। এই একবিংশ শতাব্দিতে চৌদ্দশ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেবো না আমরা। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।
ইসলামী খুনী
নব্বই দশকের শুরুর দিকে, খালেদা জিয়ার আমলে, তিন ইসলামী খুনী আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল। কেউ যদি আমার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যায়, তারা নাকি বড় অংকের টাকা দেবে। দেশের এক নাগরিককে খুন করার ইন্ধন জোগানোর জন্য ওই তিন ইসলামী খুনীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বরং বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নিজেদের পার্টিতে ওদের ঢুকিয়েছিলো, ইলেকশনেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, এমপি টেমপিও বোধহয় বানিয়েছিল।
এক মৌলবী ওয়াজ করছিল সেদিন, তার শিষ্যদের বলছিল ইসলামের সমালোচনা যারাই করবে, তাদের যেন এরা টুগরো টুগরো করে কেটে ফেলা হয়। লোকটির কি কোনও শাস্তি হবে? লোকটিকে কি গ্রেফতার করা হবে? শাসানো হবে? না। কারণ, দেশের প্রধানমন্ত্রী এই লোকটির মতোই বিশ্বাস করেন ইসলামের সমালোচকদের টুগরো টুগরো করেই কেটে ফেলা উচিত। তাই ওদের যখন এরা কেটে ফেলে, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর মৌনতা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে এই কেটে ফেল্লায় তাঁর সম্মতি রয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ১৪০০ বছর আগেও বোধহয় ইসলামী খুনীদের এখনকার মতো এত রমরমা অবস্থা ছিল না।
ইহা বোমা নহে
আহমদ মোহাম্মদ রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্ব থেকে ১৪ বছর বয়সী আহমদের জন্য পাঠানো হচ্ছে সহানুভূতি, সমর্থন, অভিনন্দন, আর অগাধ ভালোবাসা। এর কারণ নিশ্চয়ই মানুষের অপরাধবোধ। আহমদ যা নয়, তাকে তাই ভাবা হয়েছিল, সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু সন্ত্রাসী ভাবা হয়েছিল, সে কারণেই অপরাধবোধ। ঘড়ি বানিয়েছিল, যেটিকে বোমা ভেবেছে তার শিক্ষক, পুলিশ ডেকেছে, পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে ছেলেটিকে থানায় নিয়ে গেছে, একটি নিরপরাধ কিশোরের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে,– অপরাধবোধ সে কারণে। থানা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আহমদকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে, তারপরও মানুষের অপরাধবোধ কমেনি। উদারপন্থীরা ভাবছেন, যদিও মুসলমানদের বেশির ভাগ লোকই ভালো লোক, তারপরও গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে মানুষ ভয় পায়, সন্দেহের চোখে দেখে, সন্ত্রাসী বলে মনে করে। এ কারণেই একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে রয়েছে উদারপন্থীদের মনে। এ কথা তো সত্য, মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। ঠিক যেমন ক্রিশ্চানদের মধ্যে, ইহুদিদের মধ্যে, হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। এই সত্যটা সবারই জানা নেই, তাই উদারপন্থীদের লজ্জা, তাই অপরাধবোধ।