সবাই ভাবছে কোপ এবার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতিমাসেই একজনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু ব্লগার, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও। খুনীদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ওপরের নির্দেশ নেই। কুপিয়ে মারার জন্য সন্ত্রাসীরা নতুন তালিকা বানিয়েছে। ৮৪ জনের পুরোনো তালিকায় ওয়াশিকুর ছিলেন না। ওই তালিকায় মনির এবং অন্যান্য যাঁরা হুমকি পাচ্ছেন এখন, তাঁরা নেই। পুরোনো তালিকায় ছিলেন নাস্তিকের ধর্মকথা। চাপাতি চালানো খুনীরা তাঁরও পিছু নিয়েছে। শুধু ফেসবুক ব্লগারদের নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলামকে সেদিন কুপিয়ে মেরে ফেললো ইসলামী সন্ত্রাসীরা। শফিউল ইসলাম তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়। পরের দিন ইসলামী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরে ফেলেছে শফিউল ইসলামকে।
শেখ হাসিনা অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান আর অনন্ত বিজয় দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর একটি বিবৃতিও দেননি। শুনেছি তিনি পরের নির্বাচনে জেতার জন্য মৌলবাদী পটাচ্ছেন। মুক্তমনা ব্লগারদের নিরাপত্তা তো দেবেনই না, খুনীদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া ওঁদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুক। দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিবে দেশে। কিন্তু মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবির চান না ব্লগাররা দেশ ছাড়ুক। তিনি বলছেন, দেশ ছেড়ে লাভ কিছু হবে না, লাভ হবে জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে। জামাতে ইসলামি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত, কিন্তু নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা নাস্তিকদের খুন করবে না, এ হলফ করে কে বলতে পারে? এতকাল যাবৎ জামাতে ইসলামির বাইরেও লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, তারা জামাতের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। তারা আইসিস-আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবির বললেন তাঁর হাতে পিস্তল আছে, এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। শাহরিয়ার কবির না হয় লাইসেন্স সহ পিস্তল যোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্প বয়সী নাস্তিক ব্লগাররা পিস্তল কোত্থেকে যোগাড় করবে, লাইসেন্সই বা তাদের কে দেবে? যে সরকার তাদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার তো লাইসেন্স দেবে না। কিছুদিন আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। যে দল খুন করে এসে গোটা দেশকে জানিয়ে দিচ্ছে তারা খুন করেছে, তারপরও তাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে। না সরকার। তাদের নিষিদ্ধ করলেই কী, বা না করলেই কী!
হুমকি আমিও পাচ্ছিলাম। ঢাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট বলেছে, আমাকে খুন করার জন্য আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুতিনটে স্লিপার সেলকে নাকি পাঠানো হচ্ছে। দিল্লিতে। আমি কি তাই পালিয়ে আমেরিকা চলে এসেছি? পালিয়ে আসার মানুষ তো কোনওদিনই ছিলাম না। বাংলাদেশে বাস করছিলাম যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার ফাঁসি চাওয়ার জন্য মিছিল করতো। দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছিল আমাকে। পশ্চিমবঙ্গে আমার বিরোধী মৌলবাদীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদেরও বেশ যাতায়াত ছিল, সেই পশ্চিমবঙ্গে থেকে আমি বেরোইনি, আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই বাস করেছি, শুধু নির্যাতিত মানুষদের, যাদের নিয়ে লিখি, তাদের পাশে থাকার জন্য। আমি এসেছি আমেরিকায়, কাজ করছি আমেরিকার সেকুলার মানববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে, আমেরিকার সরকারকে বলে যেন বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগারদের ভিসার ব্যবস্থা করে, এবং এখানেই তাদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়। সবচেয়ে ভালো হতো ওরা যদি দেশে নিরাপত্তা পেতে। কিন্তু মুশকিল হলো সরকার মৃত্যুর হুমকি পাওয়া কোনও নাস্তিককে নিরাপত্তা দেবে না। নাস্তিকদের মৃত্যুতে সহানুভূতিও দেখাবে না। এতে যদি আবার সরকারকে নাস্তিক বলে মনে হয়। তাহলে সব্বনাশ। ভোট তো পাবে না ধর্মান্ধদের।
নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কোনওদিন কিছু করিনি আমি। লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীরা যখন দেশ জুড়ে তাণ্ডব করছিলো, আমার ফাঁসি চাইছিল, আমি দেশ ছাড়িনি, সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। আজ একুশ বছর নির্বাসনে, সারা পৃথিবীতে আমার নিজের কোনও ঘর নেই। দিল্লিতে অন্যের বাড়িতে থাকি। যে কোনও দিন পাততাড়ি গুটোতে বললে গুটোতে হবে। আক্ষরিক অর্থে গৃহহীন যাকে বলে, সে আমিই। প্রায় কুড়ি বছর আগে যখন চারদিকে আমার নাম ডাক, ইসলামী মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে কাঁচা খেয়ে ফেলবে, এই খবর যখন বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো। আমি সবাইকেই বলেছি, ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করতে হবে না। বাংলাদেশের মেয়েদের সাহায্য করো। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিলো তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে কিনা। আমি বলেছি, ও কাজটি কখনও করো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়ে পরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হতে পারবে। না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। আমার জন্য যে ফাগু তোলা হচ্ছে আমেরিকায়, তা খরচ করা হবে দেশের মুক্তমনা ব্লগারদের আমেরিকায় আসার আর থাকার খরচে।