জানি আমার স্বপ্নগুলো মানুষ পায়ে মাড়িয়ে যাবে। সে যাক। আমার কিছু যায় আসে না। আমি স্বপ্ন রচনা করে যাবোই।
ইলিশ কোরবানি
শুনেছি একটা ইলিশ নাকি ষোলো হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ঢাকায়। পয়লা বৈশাখে ইলিশ খেতে হবে যে করেই হোক, তাই যে দামই হাঁকছে ইলিশওয়ালা, সে দামেই কিনছে বাঙালি। বাঙালি না বলে ধনী বাঙালি বলাই ভালো। পয়লা বৈশাখ ইলিশ ছাড়া কী করে উৎযাপন হবে। কোরবানির ঈদের আগে চড়া দামে গরু কিনে লোকেরা যেমন চারদিকে বলে বেড়ায় কত টাকায় কিনেছে গরু, এও ঠিক তেমন, ইলিশ কিনে সবাইকে শোনাচ্ছে কত টাকায় ইলিশটা কিনেছে। যত বেশি দাম, তত বেশি ইজ্জত। পয়লা বৈশাখে গরু-খাসির বদলে ইলিশ কোরবানি দেয় মানুষ। পয়লা বৈশাখটা কি ধীরে ধীরে একটুখানি কোরবানির ঈদের মতো হয়ে উঠছে। কী ভালোই না হবে বাংলা নববর্ষ যদি কোরবানির ঈদের মতো বড় উৎসব হয়ে ওঠে। ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে নববর্ষের উৎসব নিশ্চয়ই ঢের ভালো।
তবে যেভাবেই পালন করুক, পয়লা বৈশাখটা পালন করুক বাঙালিরা। বাংলা ক্যালেণ্ডারের উৎপত্তির সঙ্গে বাংলা বা বাঙালির কতটুকু কী জড়িত সে নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বাংলা ক্যালেণ্ডারকে যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, বাঙালিরা আর ক্যাচাল না করে এর বারো মাসের তেরো পার্বণ উত্যাপন করুক ঘটা করে।
বাঙালির বাঙালিত্ব তো প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ভাষাটাই যাবো যাবো করছে। এই ভাষা গরিব লোকের ভাষা, এই ভাষা দাদু-দিদিমার ভাষা, ঠাকুম্মা- ঠাকুর্দার ভাষা। সত্যিই এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলাটা নেহাত প্রাচীন লোকদের ভাষা, চাষোভুযোদের ভাষা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হোক ঢাকা শহরে, প্রতি পয়লা বৈশাখে। কুটির শিল্পের মেলা হোক। মানুষ কাঁচা লংকা আর পান্তা ভাত খাক। কেউ কেউ টিপ্পনি কাটে, বছরের একদিন পান্তা খেয়ে কী লাভ, বাকি দিনগুলোয় তো মোগলাই খাচ্ছে। আমার বক্তব্য, বছরে একদিনই উৎসব করুক। একদিন বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই দেখুক, তাদের সংস্কৃতিটা ঠিক কী। একদিন দেখুক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, শাড়ি ধূতি, নাচ গান, আল্পনা, কাগজের হাতি ঘোড়া। একদিন বাংলায় কথা বলুক, একদিনের জন্য হলেও শত ভাগ বাঙালি হোক।
একদিনের জন্য হলেও উৎসবটা করা জরুরি, কারণ সামনে এমন দিন আসছে, এই একটা দিনও হয়তো আর বাঙালির উৎসবের জন্য জুটবে না। এখনই ইসলামি মৌলবাদীরা হুমকি দিচ্ছে, পয়লা বৈশাখ যেন পালন না করা হয়। একবার তো রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল ওরা। এরপর বলা যায় না হয়তো পয়লা বৈশাখের উৎসব যারা করবে, তাদের দিন দুপুরে জবাই করে ফেলে রাখবে রাস্তায়। যারা আরবের সংস্কৃতিকে গায়ের জোরে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে, তারা খুব ভয়ংকর, তারা আজ বাংলাদেশে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। তাদের এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে টাকা। তাদের মাথার ওপর সরকারি আশির্বাদের হাত।
সূতরাং পয়লা বৈশাখের উৎসব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে যত পারুক উৎসব করে নিক বাঙালি। যত পারুক বাংলা গান গেয়ে নিক। যত পারুক নেচে নিক। যত পারুক ঢাক ঢোল বাজিয়ে নিক। যত পারুক মুড়ি মুড়কির মেলা করে নিক। কবে আবার কাকে হিজাব বোরখা আর টুপি জোব্বার আড়ালে চলে যেতে হয় কে জানে।
সত্যি বলছি, খুব দাম দিয়ে মানুষ ইলিশ কিনছে বলে আমার ভালো লাগছে। মানুষ গর্ব করে বলুক, তারা বাঙালি। বন্ধুদের ডেকে ডেকে দেখাক, আত্মীয় পড়শিদের দেখাক সদ্য কেনা রূপোলি রূপোলি ইলিশ। পয়লা বৈশাখের পেছনে যত টাকা যায়, যাক। বাঙালিকে সারাবছর বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে হয়, একদিন অন্তত বাঙালিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠুক। যত হুমকিই আসুক, যত শত্রুই থাকুক বাঙালির আশেপাশে, তবুও যেন অকুতোভয়ের মতো পালন করে যায় বছরের একদিনের এই উৎসব।
ইহুদিরা আজও নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। নিজভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে ওরা হাজার হাজার বছর কাটিয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে, ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে, সংখ্যালঘু হয়ে, নিরন্তর অপমান সয়ে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কী করে এতকাল তারা বেঁচে ছিল, এই বিস্ময় জাগায়। এতদিনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সব। কিন্তু না, সবই টিকে আছে। কারণ হাজার বছর ধরে ঘরে ঘরে নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতির চর্চা চালু রেখেছিল বলেই টিকে আছে। যে করেই হোক টিকিয়ে রাখবে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলো বলেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
ইহুদি পারলে বাঙালি পারবে না কেন! নিশ্চয়ই পারবে, যদি নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিকে ইহুদিদের মতো ভালবাসে। এখানেই আমার সংশয়, আমার মনে হয়। বাঙালি তাদের সংস্কৃতিকে সত্যিকার ভালোবাসে না। বাসে না বলেই অত সহজে আরবের এবং ইংরেজের সংস্কৃতি বাংলাকে দখল করে নিতে পেরেছে। এই অবাঙালির দেশে আমি কী করে কাটাবো আমার পয়লা বৈশাখ!পদ্মার ইলিশ কোথায় পাবো, রমনার বটমূলে গানই বা কী করে শুনতে যাবো! আমি না হয় দূর থেকেই সবার আনন্দ দেখলাম। না হয় দূর থেকেই গানের সুর শুনলাম। কাছে যাওয়া আমার না-ই হলো। সবার কি আর সব হয়!
ইসলামী ইনকুইজেশন
নির হোসেন অনন্ত বিজয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একসঙ্গে যুক্তি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল নামে এক সংগঠন গড়েছিলেন সিলেটে। অনন্তর মতো মনিরও ব্লগ লিখতেন মুক্তমনায়। অনন্ত বিজয় আর মনির দুজনকেই ইসলামী সন্ত্রাসীরা হুমকি দিতো ফোনে। অনন্তর জন্য তারপরও একটা ব্যবস্থা হয়েছিলো। সুইডেনের লেখক-কবিদের সংগঠন পেন থেকে একটা আমন্ত্রণ পত্র যোগাড় হয়েছিল। মনির অনন্তর সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলো যেদিন সুইডেনের ভিসার জন্য আবেদন করেন অনন্ত, ১২ এপ্রিল তারিখে সুইডেনের দূতাবাস অনন্তর সাক্ষাৎকার নেয়, ২২ এপ্রিল তারিখে জানিয়ে দেয়, তারা অনন্তকে ভিসা দেবে না। সিলেটে ফিরে আসার পর ১২ মে তারিখে অনন্তকে দিন দুপুরে কুপিয়ে মেরে ফেলে ইসলামী জঙ্গিরা। অনন্তকে খুন করার পর মনিরকে ফোনে হুমকি দিচ্ছে। অচেনা কণ্ঠ বলছে, রেডি হয়ে যা। নেক্সট তুই। কেউ আবার কোনও কথা না বলে ফোনে কোরানের সুরা বাজাচ্ছে। মনির সিলেটের একটা কলেজে বাংলা পড়াতেন। এখন চাকরি বাকরি সব ফেলে। সিলেট ছেড়েছেন মনির। ঢাকায় বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে আছেন। ঘর থেকে কোথাও বের হচ্ছেন না। চেষ্টা করছেন দেশের বাইরে চলে যাওয়ার। যোগাযোগ করছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে। ভিসা এখনও জুটছে না। সিদ্ধার্থ ধরও হুমকি পাচ্ছেন। কিছুদিন আগে আমেরিকার দূতাবাস থেকে ঘুরে এসেছেন। ভিসা পাননি। নিলয় নীল আর সন্ন্যাসী রতনের বাড়িতে তল্লাশি চলেছে, ওঁরা পালিয়ে গেছেন অচেনা গ্রামে। সম্ভবত চেহারা বদলে নিয়েছেন। দাড়ি রাখছেন। বেশভুষা নাম ধাম। সব বদলে ফেলেছেন। ভিসা না পেলে মনিরও চলে যাবেন গহীন গ্রামে। যেখানে কেউ তাঁকে চিনতে পারবে না। শহরে আছেন অনন্য আজাদ, তিনিও দেশ ছাড়তে চাইছেন। মাথায় হেলমেট পরে ঘর থেকে বেরোন। অতর্কিতে কোপাতে এলে যেন হেলমেটের কারণে মাথাটা বাঁচে। কোপ খেয়েও আসিফ মহীউদ্দিন প্রাণে বেঁচেছিলেন, মোটা শীতের কাপড় পরা ছিল বলে। মুক্তচিন্তক ব্লগারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আতংক। মোহাম্মদ ইসলামের মতো দেশের অনেক মুক্তচিন্তক ব্লগার লেখালেখি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় বাস করছেন যাঁরা, তাঁরাই শুধু নির্ভয়ে লিখতে পারছেন। মসিউর রহমান (মরহুম আল্লামা শয়তান)এর নাম ৮৪ জনের তালিকায়, হাসিনার সরকার তাঁকে জেলেও রেখেছিলো কয়েকমাস। সঙ্গে ছিলেন আসিফ মহীউদ্দিন আর সুব্রত শুভ। আসিফ আর সুব্রত দেশ ছেড়েছেন। মসিউর রহমান এখনও সুযোগ পাননি দেশ ছাড়ার। এখনও ফেসবুকে লিখছেন। তবে ধার কমিয়ে দিয়েছেন লেখায়। তাতে কি ক্ষমা পাবেন? ধর্মান্ধদের অভিধানে দয়া মায়া ক্ষমা এসব নেই।