আমার রিস্টওয়াচটা খুঁইজা পাইতেছি না, একজন লোক আমারে ইনভাইট করছে, আমার তো টাইম চইলা যাবে। যে তিনটি ইংরেজি শব্দ এখানে ব্যবহার হচ্ছে, সেই তিনটি শব্দের যে কোনও বাংলা শব্দ নেই, তা নয়, আছে এবং সে শব্দগুলো যে অচল হয়ে গেছে তাও নয়, রীতিমতো সচল শব্দ, কিন্তু তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে না, কী কারণ এর? কোনও কারণ নেই। বাঙালির বেশির ভাগ কথা ও কাজের পেছনে অনেক সময় কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অকারণে বিস্তর কথা বলে বাঙালি, অকারণে বিস্তর কাজও করে। রাগারাগি, দলাদলি, খুনোখুনি নানা রকম কাজ। যুক্তিহীন কাজ। ভাষার প্রতি আবেগ ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির মনে উথলে ওঠে, এ কথা ঠিক, কিন্তু সারা বছর ভাষাটিকে ভাল না বাসলে এক মাসের ভালবাসায় আর যার লাভ হোক, ভাষার কোনও লাভ হয় না। দেশকে না ভালবাসলে ভাষাকে ভালবাসা যায় না। আর ভাষাকে ভাল না বাসলে নিজেকে ভালবাসা যায় না, নিজেকে ভাল না বাসলে অন্যকে ভালবাসা যায় না। অন্যকে ভাল না বাসলে মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য ও প্রীতি যা একটি সুস্থ দেশের জন্য প্রয়োজন, তা বিনষ্ট হতে সময় নেয় না। অন্যের গোলামি করা আর অন্যকে ভালবাসা দুটো দুজিনিস।
রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন। সেটি অন্য রকম করে বলতে ইচ্ছে হয়, বাঙালি যদি মানুষ হতে চায়, তাকে আগে বাঙালি হতে হবে। দেশ ও জাতিকে, জাতির ভাষাকে সংস্কৃতিকে ভালবেসে রফিক-সালাম বরকতের উত্তরসূরিরা, বাংলাদেশ নামের দেশটি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের দেশ হিসেবে চিরকাল যেন সম্মানিত হয়, সেরকম একটি ব্যবস্থা করবেন, এ কেবল আশা নয় আমার, স্বপ্নও।
আমি কোথায় এখন?
ভারত থেকে প্রায়ই আমিইউরোপ অথবা আমেরিকায় যাই, সাধারণতবিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার বা মানবাধিকার নিয়ে বক্তৃতা করতে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আজ বাইশ বছর। যেখানেই বাস করি না কেন, বক্তৃতার জন্য আমাকে যেতে হয় বিভিন্ন দেশে। ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও পত্রিকায় আমার বক্তৃতা করা, আমার সম্মান অর্জন, মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পাওয়া, এসব নিয়ে কিছু কখনও লেখেনি। লিখেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায়, কটা পুরুষের সঙ্গে আমি শুয়েছি, মোট কজনকে বিয়ে করেছি, এবং কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, এবং মৌলবাদীরা কী করে আমাকে প্যাদানি দিচ্ছে, আমার দিকে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারছে, রাজ্য কী করে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, কী করে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়েছে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ বিতর্কিত। এই শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। এই বিতর্কিত বিশেষণটি তারাইতিবাচক নয়, ব্যবহার করে নেতিবাচক অর্থে। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, আমাকে বানিয়েছে আস্ত একটা নিষিদ্ধ নাম, আপাদমস্তক নিষিদ্ধ লেখক। ভারত থেকে আমি এখন আমেরিকায় এসেছি, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি জন্মের মতো ছেড়ে এসেছি ভারত। ভারতে এখনও আমার সবকিছু, সমস্ত জরুরি জিনিসপত্র। আমি শুধু ছোট একটা সুটকেসে নিয়ে আমেরিকায় এসেছি, সঙ্গে এনেছি আমার নিত্যসঙ্গী ল্যাপটপ আর আইপ্যাড। আর আমার এক জোড়া রিডিং গ্লাস। দেশের বাইরে যেখানেই যাই, এগুলো নিয়েই যাই।
বাংলাদেশ আমাকে তাড়িয়েছে। আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল আর নারীবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীলের দল দুদলই দুযুগ ধরে আমার পেছনে –আমাকে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, অবাধে আমার কুৎসা রটাতে ব্যস্ত। ইউরোপ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিলাম। বাংলাকে ভালোবেসে কী অসম্ভব অসম্ভব কাগুই না করেছি। সেখানেও ওই একই ঘটনা ঘটলো, রাজনীতিক, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল, আর এক দল সেকুলার নামধারী কাপুরুষ আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমাকে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল দুহাজার আট সালে। তারপরও ফিরে ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে দাবি। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ, তারপরও ওই দিল্লিতেই থেকেছি। কেন দিল্লিতে পড়ে আছি, কেউ প্রশ্ন করলে বলতাম, যেহেতু এখানকার গাছগুলো চিনি। দিল্লি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর, নতুন চারদিক। তারপরও রয়েছি দিল্লিতে, কারণ গোটা ভারতবর্ষে ওই ছোট শহরটি ছাড়া আর কোনও শহর ছিল না আমার থাকার। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারত-বাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারত বাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুমাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার স্বাধীনতা চাই বা অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাক স্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করবো, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে দুররা মারা হবে না, আমাকে পাথর ছোঁড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্য।