মেয়েরা যদি পুরুষের শেখানো ভাষায় না লেখে, কী বলবে-কতটুকু বলবে কোথায় সীমা টানবে— এই রুলটা না মানে, তবে পুরুষতান্ত্রিক লোকদের বড় রাগ হয়। এই সমাজে যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের গায়ে রাগ না ধরাতে পারে, যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের কাছ থেকে নষ্ট, স্লাট, বেশ্যা ইত্যাদি আখ্যা না পায় — সেই মেয়েদের নিয়ে খুব বেশি আশা করার নেই। নারীবিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস যারা করে না, যারা অবাধ্য, যারা নিয়ম ভাঙে, তারাই সমাজ পাল্টায়। তারাই বিবর্তন ঘটায়। আমি তাদেরই স্যালুট করি।
যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে যাদবপুরের আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের জানাচ্ছি আমার সংগ্রামী অভিনন্দন। সারা দেশে কন্যাশিশু হত্যা, বাল্য বিবাহ, পণপ্রথা, বধূনির্যাতন, বধূহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন, ঘৃণা, ইত্যাদির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, রাস্তা ঘাটে নেই, এমনকী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও নেই। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার কথা, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ে জ্ঞান দেয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে, সচেতন করে, আলোকিত করে — সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা ঘটে, এর চেয়ে লজ্জা আর কী আছে। সবচেয়ে সুস্থ, শিক্ষিত, সচেতন, চরিত্রবান, আদর্শবান নাগরিক তো আশা করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীকেই সরব হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সত্যিকার শিক্ষিত হওয়া হয় না। নারীকে যারা যৌনবস্তু ঠাওরায়, তাদের শিক্ষিত বলে গণ্য করা উচিত নয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে যদি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ভালো চোখে না দেখে, তাহলে বুঝতে হবে রাজ্য সরকার নারীর অধিকারকে ভালো চোখে দেখে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী। পুরুষতন্ত্র এমনই ভয়ংকর ক্ষমতাধর যে নারীকেও, বাধ্য করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গ্রহণ করতে। বদ-পুরুষের মতো অনেক নারী ধর্ষণের জন্য দোষ দেয় ধর্ষিতাকে। যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাকে অন্যায় বলে ধরে নেয় যাদবপুরের প্রশাসন, তবে বুঝতে হবে এই প্রশাসন আজ নারীবিদ্বেষীদের দখলে। সত্যিকার শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব আজকাল। এখন তরুণদের ওপর ভরসা। ওরাই জীর্ণ পুরাতনকে বিদেয় করবে।
হজ্ব
মক্কার পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরার দৃশ্য দেখার পরও কি মানুষ আবার হজু করতে মক্কা যাবে? শুনেছি এগারোশ নাকি তেরোশ মানুষ শুধু মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরেছে। আহা কী করুণ মৃত্যু! লাশগুলোকে বুলডোজার দিয়ে আবর্জনার মতো ফেলেছে সৌদি সরকার। সৌদি রাজপরিবারের বর্বরতা কারও অজানা নয়। কোনও এক রাজপুত্তুর নাকি ও পথ দিয়ে যাবেন, তাই তাঁর পথটি সাফ করতে গিয়ে আশেপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যেসব রাস্তা ধরে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ কোন এক অদৃশ্য শয়তানকে পাথর ছুড়বে বলে ছুটছিল। শয়তান কি এমনই শক্তিশালী যে তাকে মারার জন্য লক্ষ লক্ষ পাথরের দরকার পড়ে? তাছাড়া, পাথর ছুড়লে কি শয়তান মরে? শয়তান তো রূপকথার চরিত্র। একটা শিশুতোষ রূপকথার জন্য কত কত লোককে আজ মরতে হলো। মানুষ আর কতকাল এইসব রূপকথাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস খুব ভয়ংকর, এ কোনও যুক্তি বোঝে না।
আমার ধর্মে বিশ্বাস থাকলেও মরতে আমি মক্কা যেতাম না। মানুষের যেমন সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার আছে।
হাতি ঘোড়া
আজ বিকেলে নিরিবিলি এক রাস্তায় হঠাৎ দেখলাম হাতি, লাফিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে। হাতি দেখলেই আমি কাছে গিয়ে কুশল শুধাই। এই হাতির শরীরে ফুল পাতা আঁকছিল একটি ছেলে। হাতিও জানতো তাকে সাজানো হচ্ছে। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে সাহায্য করছিল সাজাতে। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল দুটো উট। বিয়ে বাড়িতে নাচতে এসেছে ওরা। যখন উটের মাহুতকে বললাম, উট কী করে নাচে দেখবো। মাহুত বললো, এখানে ডিজে নেই, গান নেই, নাচবে কী করে ওরা, ওরা তো গানের সঙ্গে নাচে।
কষ্ট হয় যখন দেখি মানুষ হাতিঘোড়াউটমোষকে বন্দি করেছে। ক্রীতদাস বানিয়েছে। দড়ি খুলে দিলে হয় না? মুক্ত ঘুরে বেড়াক সকলে। এই পৃথিবী তো ওদেরও। ওদের কি ইচ্ছে হয় না যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে বাঁচতে!
হুমায়ুন আজাদ
বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদকে প্রথাবিরোধী বলে কেউ কেউ। হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী ছিলেন না, তিনি একটা কট্টর পুরুষতান্ত্রিক লোক ছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক প্রথায় তিনি গভীর বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রথামত জীবন যাপন করেছেন। তিনি গৃহের কর্তা ছিলেন এবং সন্তানদের নামের শেষে তিনি নিজের পদবী জুড়ে দিয়েছেন। তিনি নারীবিদ্বেষী ছিলেন। নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখতেন। স্ত্রীর আড়ালে তিনি ঘরের বাইরে অন্য নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকতেন। তিনি রক্ষিতাও পুষতেন। তিনি প্রচণ্ড মিত্থুক লোক ছিলেন। আমি নাকি তাঁকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এই মিথ্যে কথা বলে তিনি সবার সামনে দাঁত কেলিয়ে হাসতেন। আমি তখন নারীবাদী সংগ্রামী লেখক, আমাকে নিয়ে অপমানজনক এবং মিথ্যে বলতে লোকটির লজ্জা হয়নি। তিনি প্রায়ই প্রতিষ্ঠিত লেখক লেখিকা সম্পর্কে অশোভন এবং অশ্লীল মন্তব্য করতেন। নারী সম্পর্কে তাঁর উক্তি বরাবরই ছিল বড় কুৎসিত এবং নোংরা। আমার নারীবাদী কলামের জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর এমনই লোভ হতো যে নারী নিয়ে একটা বই লিখে ফেললেন। নারী বইটি তার কোনও মৌলিক বই নই। এটি পৃথিবীর নারীবাদীরা যা যা এতকাল বলেছেন, তা শুধু অনুবাদ করে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন মাত্র। হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিজীবনে একটা মিথ্যুক, লম্পট, চরিত্রহীন লোক ছিলেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক স্তাবক নিয়ে সবসময় ঘোরাফেরা করতেন।