এভাবে কি ধর্মটিকে থাকে? পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ছিল। এখন তারা বেশির ভাগই বিলুপ্ত। কোথায় আজ অলিমাপিয়া পাহাড়ের সেই ডাক সাইটে গ্রীক দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমানদের নামীদামী ঈশ্বর? কোথায় মিশরীয় ফারাওদের ঈশ্বর? সব আজ ইতিহাস। ইসলাম, ক্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মও একসময় ইতিহাস হবে। যুগোপযোগি নতুন ধর্ম আসবে অথবা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতায় মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।
ভারতবর্ষে অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিতর্কে একটুখানি যা লাভের লাভ হয়েছে তা হলো প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আশির দশকে রুশদির বই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। অসহিষ্ণুতা যে শুধু ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে তা নয়, রাজনীতিকদের মধ্যেও প্রচও। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন, আমাকে রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছেন,তৃণমূল সরকার কলকাতা বইমেলায় আমার বই উদ্বোধনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে, টিভির জন্য লেখা আমার মেগা সিরিয়াল দেখাতেই দেয়নি। সবই মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করার জন্য এবং মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, চিদাম্বরমের মতো পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও কি তাঁদের ভুল স্বীকার করবেন? না, তাঁরা ভুল স্বীকার করবেন না। ভুলটাই আজকের রাজনীতিকদের কাছে বাস্তবতা, যে বাস্তবতা ছাড়া, তাঁরা বিশ্বাস করেন, ভোটে জেতা সম্ভব নয়।
এভাবেই চলবে ভারতবর্ষ, যেভাবে চলছে। এভাবেই চলবে পৃথিবী। অশিক্ষা, জড়তা আর মুখর্ত চলবে শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিক নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পাল্টাবে। হাতে গোণা কিছু মানুষই সমাজ পাল্টায়। চিরকাল তাই হয়েছে।
মানুষ মূলত অসহিষ্ণু। মানুষ ভালোবাসতে যেমন জানে, ঘৃণা করতেও জানে। আজ বিতর্ক হোক, বিতর্ক ছাড়া সমাজ এগোয় না। অসহিষ্ণুতার পক্ষে বিপক্ষে যা হচ্ছে, তা বেশ লাগছে। শুধু ভায়োলেন্সটা যেন না হয়। ভায়োলেন্সটা বা বর্বরতাটা মানুষের রক্তে। রক্ত থেকে এই জিনিসটা বিয়ে করতে পারলে মানুষের জয় নিশ্চিত।
অ্যাসেম্বলি
একবার আমাকে ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বা ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে ওয়ার্ল্ড রিফিউজি ডে বা বিশ্ব শরণার্থি দিবসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। ওই আমার প্রথম ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ঢোকা। সেদিন পার্লামেন্টের কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ চেঁচিয়ে বলেন স্পিকার আসছেন। তারপর ঝলমলে পোশাক পরা চেঁচানো লোকটি স্পিকারকে নিয়ে টয় সোলজারের মতো হেঁটে হেঁটে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন, হাতে মোটাসোটা একটা সোনার লাঠি। স্পিকার যখন বেরোন, তখনও একই রকম চেঁচিয়ে লোকটি বলেন, স্পিকার কক্ষ ত্যাগ করছেন। ফ্রান্স কত কিছু চুরমার করে দিল, কত নিয়ম ভেঙে দিল, কত সংস্কার পুড়িয়ে দিল, বড় বড় সিংহাসন গুঁড়িয়ে দিল,রাজা রানিকে মেরে ফেললো,আর আজও পার্লামেন্টের এই চেঁচানো বন্ধ করতে পারলো না!
দুটো ছবি এখানে। একটিতে আমি, ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে, আমার পেছনে স্পিকার, আমার সামনে বিশ্বের নামী পলিটিক্যাল রিফিউজিবৃন্দ। দ্বিতীয় ছবিটি, অন্য সময় ওই একই কক্ষ।
আইসিস
ইজরাইল আর আমেরিকা আইসিসকে গড়েছে? ইজরাইল আর আমেরিকাকে তাদের অন্যায় আর নির্বুদ্ধিতার জন্য যত খুশি গালাগালি দাও। কিন্তু আইসিসের প্রতি সহানুভূতি দেখিও না। আইসিস নিরীহ মানুষদের খুন করছে। এই খুন ওরা নিজেদের বুদ্ধিতেই করছে। ইজরাইল আর আমেরিকা নয়, ওদের খুন করার প্রেরণা দিচ্ছে ওদের ধর্ম। ইজরাইল আর আমেরিকা আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করলেও, খুন করার ট্রেনিং না দিলেও, ওরা খুন করতো। বাংলাদেশের ইসলামী-খুনীদের ইজরাইল। আর আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না। চাপাতির সাপ্লাই ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসছে না। ইসলামী-খুনীরা পাথর ছুঁড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না।
আচ্ছা এত প্ল্যান করে ওরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে কেন? প্ল্যান করে যে দেশের সরকারের ওপর রাগ, সে দেশের সরকারকে মারার চেষ্টা করলেই তো পারে।
আমার দুঃখিনী বর্ণমালা
পৃথিবীর প্রায় পঁচিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাঙালির জন্য এটি খুব বড় গৌরব। কিন্তু বাঙালি কি নিজের ভাষা নিয়ে সত্যিই গৌরবান্বিত? যে ভাষাটিকে ভালবেসে বাহান্ন সালে রাজপথে নেমেছিল অগণন বাঙালি, যে ভাষাটির জন্য মমতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এনেছিল এবং যে আকাশচারী স্বপ্নটিই দীর্ঘ নমাস যুদ্ধের পর হাতের মুঠোয় এসেছিল, বাঙালি কি গৌরব করে সেই স্বপ্নময় ভাষাটির জন্য? আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক করুণ, ওখানে কান পাতলে ইংরেজি, হিন্দি শোনা যায়, বাংলা নয়। যেন বাংলা অচ্ছ্যুতের ভাষা। এ ভাষায় কথা বললে জাতে ওঠা যায় না, জাতে ওঠার প্রথম শর্ত নিজের ভাষা বাংলাটি ত্যাগ করা। হায় দুর্ভাগা জাতি। একটি বাংলা রাষ্ট্র হয়েও পশ্চিমবঙ্গের অফিস-আদালত সব কিছুর কাজ ইংরেজিতে হয়, দোকাঁপাটের সাইনবোর্ড হাতেগোনা বাংলা, বাদবাকি হয় ইংরেজি নয় হিন্দি। ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করছে, ইংরেজি, হিন্দি ছাড়া নাকি ভবিষ্যৎ নেই। ভালো চাকরি করতে চলে যাচ্ছে বোম্বে-ব্যাঙ্গালুরু। অবাঙালি যারা পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে আসে, তারা সারা জীবন ওখানে থেকে যেতে পারে এক অক্ষর বাংলা না জেনে। ভিন ভাষার চাপে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার প্রাণ যায়-যায়। ভাষার প্রাণটি বাঁচাতে রাস্তায় নামছেন ওখানকার কিছু সচেতন বাঙালি। আন্দোলন করেও যে খুব কিছু লাভ হয়েছে বা হচ্ছে তা আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বলেন, বাংলা টিকে থাকবে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশে বাঙালির সংখ্যা বেশি, এটি কোনও দেশের ছোট্ট দারিদ্র প্রদেশ নয় যে, বাংলা রক্ষায় কোনও অশান্তি হবে। কিন্তু বাংলাদেশেই কি বাংলা রক্ষা হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে ভালবাসে কজন? সারা দেশে কচুরিপানার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরেজি ইস্কুল। বাচ্চাকে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ানোর জন্য বাবা-মা আকূল। বাচ্চার মুখে বাংলা ছড়া শোনার চেয়ে ইংরেজি রাইম শুনতে তাদের আগ্রহ বেশি। বাংলা বলতে গিয়ে অযথা কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা একধরনের বাতিক বাঙালির। ইংরেজি বলতে যে জানে, তাকেই ধারণা করা হয়, শিক্ষিত। বিদ্যা জাহির করতে গেলে ইংরেজি ছাড়া উপায় নেই বলে অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস। তো এই যখন অবস্থা তখন কী করে বলি যে, বাঙালি গৌরব করে নিজের ভাষাটি নিয়ে? অনেকে বলে অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা নেই, তাই নাকি ইংরেজি শব্দের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার। বাংলা পরিভাষিকগণ, আমি ঠিক বুঝি না কী করছেন ওই আকাদেমিতে বসে? অতলান্তিকের ওপর ছোট্ট একটি দ্বীপ, আইসল্যান্ড নাম, মাত্র তিন লক্ষ লোকের বাস, সে দেশের ভাষাটির মধ্যেও কোনও রকম ইংরেজি শব্দ ঢুকতে দেয়া হয় না। প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি শব্দ এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে বিশ্বময়, কিন্তু আইসল্যান্ডের মতো ছোট্ট দেশটিতেও ওই সব শব্দকে শব্দান্তরিত করা হয়। ভাষাকে ভালবাসলে এই করতে হয়।