১. গাছ কি কি আঘাতে উত্তেজিত হয় এবং কিরূপে সেই আঘাতের মাত্রা নিরূপিত হইতে পারে?
২. আঘাত পাইয়া গাছ উত্তরে কিরূপ সংকেত করে?
৩. কি প্রকারে সেই সংকেত লিপিরূপে অঙ্কিত হইতে পারে?
৪. সেই লেখার ভঙ্গী হইতে কি করিয়া গাছের ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে?
৫. গাছের হাত, অর্থাৎ ডাল কাটিলে গাছ কি ভাবে তাহা অনুভব করে?
৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
পূর্বেই বলিয়াছি, আমাদের কোনো অঙ্গে আঘাত করিলে সেখানে একটা বিকারের ভাব উৎপন্ন হয়। তাহাতে অঙ্গ সংকুচিত হয়। তদ্ভিন্ন আহত স্থান হইতে সেই বিকার- জনিত একটা ধাক্কা স্নায়ুসূত্র দিয়া মস্তিষ্কে আঘাত করে; তাহা আমরা আঘাতের মাত্রা ও প্রকৃতিভেদে সুখ কিংবা দুঃখ বলিয়া মনে করি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাঁধিলে যদিও নড়িবার শক্তি বন্ধ হয়, তথাপি সেই স্নায়ুসূত্র বাহিয়া যে সংবাদ যায় তাহা বন্ধ হয় না। বৃক্ষকে তার দিয়া বৈদ্যুতিক কলের সঙ্গে সংযোগ করিলে দেখা যায় যে, গাছকে আঘাত করিবামাত্র সে একটা বৈদ্যুতিক সাড়া দিতেছে। গাছের মৃত্যুর পর আর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। এইরূপে সকল প্রকার গাছ এবং তাহার প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আঘাত অনুভব করিয়া যে সাড়া দেয় তাহা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছি।
কোনো কোনো গাছ আছে যাহারা নড়িয়া সাড়া দেয়; যেমন লজ্জাবতী লতা। প্রতি পত্র-মূলের নীচের দিকে উদ্ভিদপেশী অপেক্ষাকৃত স্থূল। আমাদের মাংসপেশী আহত হইলে যেরূপ সংকুচিত হয়, পত্রমূলের নীচের দিকের উদ্ভিদপেশীও আঘাতে সেরূপ সংকুচিত হয়। তাহার ফলে পাতাটা পড়িয়া যায়। আঘাতজনিত আকস্মিক সংকোচের পরে গাছ প্রকৃতিস্থ হয় এবং পাতাটা আবার পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হইয়া উত্থিত হয়। মানুষ যেরূপ হাত নাড়িয়া সাড়া দেয়, লজ্জাবতী সেইরূপ পাতা নড়িয়া সাড়া দেয়।
মানুষকে যেরূপে উত্তেজিত করা যায়, লজ্জাবতীকে ঠিক সেই প্রকারে- যেমন লাঠির আঘাত দিয়া, চিম্টি কাটিয়া, উত্তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা দিয়া, অ্যাসিডে পোড়াইয়া উত্তেজিত করা যাইতে পারে। এই সকল নাড়া পাইয়া পাতা সাড়া দেয়। তবে এই সকল ভীষণ তাড়না পাতা অধিক কাল সহ্য করিতে না পারিয়া প্রাণত্যাগ করে। সুতরাং দীর্ঘকাল পরীক্ষার জন্য এমন কোনো মৃদু তাড়নার ব্যবস্থা আবশ্যক যাহাতে পাতার প্রাণনাশ না হয় এবং নাড়ার মাত্রাটা যেন ঠিক এক পরিমাণে থাকে।
গাছটিকে কোনো সহজ উপায়ে নিদ্রিত অথবা নিশ্চল অবস্থা হইতে জাগাইতে হইবে। রাজকন্যা মায়াবশে নিদ্রিত ছিলেন; সোনার কাঠি ও রূপার কাঠির স্পর্শে তাঁহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। সম্মুখের পরীক্ষা হইতে জানা যাইতেছে যে, সোনার কাঠি ও রূপার কাঠি স্পর্শ করা মাত্র লজ্জাবতী লতা ও নিশ্চল ব্যাঙ পাতা ও গা নাড়িয়া সাড়া দিল। ইহার কারণ এই যে, দুই বিভিন্ন ধাতুর স্পর্শ হইলেই বিদ্যুৎস্রোত বহিতে থাকে এবং সেই বিদ্যুৎবলে সর্বপ্রকার জীব ও উদ্ভিদ একইরূপে উত্তেজিত হয়। বিদ্যুৎশক্তি দ্বারা উত্তেজিত করিবার সুবিধা এই যে, কল দ্বারা উহার শক্তি হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়, অথবা একই প্রকার রাখা যাইতে পারে। ইচ্ছাক্রমে বিদ্যুতের আঘাত বজ্রানুরূপ ভীষণ করিয়া মুহূর্তে জীবন ধ্বংস করা যাইতে পারে, অথবা কলের কাঁটা ঘুরাইয়া আঘাত মৃদু হইতে মৃদুতর করা যায়। এইরূপ মৃদু আঘাতে বৃক্ষের কোনো অনিষ্ট হয় না।
৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
গাছের সাড়া দিবার কথা বলিয়াছি। এখন কঠিন সমস্যা এই যে, কি করিয়া গাছের সাড়া লিপিবদ্ধ করা যাইতে পারে। জন্তুর সাড়া সাধারণতঃ কলম সংযোগে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে। কিন্তু চড়ুই পাখির লেজে কুলা বাঁধিলে তাহার উড়িবার যেরূপ সাহায্য হয়, গাছের পাতার সহিত কলম বাঁধিলে তাহার লিখিবার সাহায্যও সেইরূপই হইয়া থাকে। এমন-কি, বনচাঁড়ালের ক্ষুদ্র পত্র সুতার ভার পর্যন্তও সহিতে পারে না; সুতরাং সে যে কলম ঠেলিয়া সাড়া লিখিবে এরূপ কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এ জন্য আমি অন্য উপায় গ্রহণ করিয়াছিলাম। আলো-রেখার কোনো ওজন নাই। প্রথমতঃ প্রতিবিম্বিত আলো-রেখার সাহায্যে আমি বৃক্ষপত্রের বিবিধ লিপিভঙ্গী স্বহস্তে লিখিয়া লইয়াছিলাম। ইহা সম্পাদন করিতেও বহু বৎসর লাগিয়াছিল। যখন এই সকল নূতন কথা জীবতত্ত্ববিদ্দিগের নিকট উপস্থিত করিলাম তখন তাঁহারা যারপরনাই বিস্মিত হইলেন। পরিশেষে আমাকে জানাইলেন যে, এই সকল তত্ত্ব এরূপ অভাবনীয় যে, যদি কোনোদিন বৃক্ষ স্বহস্তে লিখিয়া সাক্ষ্য দেয়, কেবল তাহা হইলেই তাঁহারা এরূপ নূতন কথা মানিয়া লইবেন।
যেদিন এ সংবাদ আসিল সেদিন সকল আলো যেন আমার চক্ষে নিবিয়া গেল। কিন্তু পূর্ব হইতেই জানিতাম- সফলতা বিফলতারই উল্টা পিঠ। এ কথাটা নূতন করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করিলাম। বারো বৎসর পর শাপই বর হইল। সেই বারো বৎসরের কথা সংক্ষেপে বলিব। কলটি সম্পূর্ণ নূতন করিয়া গড়িলাম। অতি সূক্ষ্ম তার দিয়া একান্ত লঘু ওজনের কলম প্রস্তুত করিলাম। সে কলমটিও মরকতনির্মিত জুয়েলের উপর স্থাপিত হইল, যেন পাতার একটু টানেই লেখনী সহজে ঘুরিতে পারে। এতদিন পরে বৃক্ষপত্রের স্পন্দনের সহিত লেখনী স্পন্দিত হইতে লাগিল। তাহার পর লিখিবার কাগজের ঘর্ষণের বিরুদ্ধে কলম আর উঠিতে পারিল না। কাগজ ছাড়িয়া মসৃণ কাচের উপর প্রদীপের কৃষ্ণ কাজল লেপিলাম। কৃষ্ণ লিপিপটে শুভ্র লেখা হইল। ইহাতে ঘর্ষণের বাধাও অনেকটা কমিয়া গেল; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও গাছের পাতা সেই সামান্য ঘর্ষণের বাধা ঠেলিয়া কলম চালাইতে পারিল না। ইহার পর অসম্ভবকে সম্ভব করিতে আরও ৫।৬ বৎসর লাগিল। তাহা আমার ‘সমতাল’ যন্ত্রের উদ্ভাবন দ্বারা সম্ভাবিত হইয়াছে। এই সকল কলের গঠনপ্রণালী বর্ণনা করিয়া আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি করিব না। তবে ইহা বলা আবশ্যক যে, এই সকল কলের দ্বারা বৃক্ষের বহুবিধ সাড়া লিখিত হয়। বৃক্ষের বৃদ্ধি মুহূর্তে নির্ণীত হয় এবং এইরূপে তাহার স্বতঃস্পন্দন লিপিবদ্ধ হয় এবং জীবন ও মৃত্যু-রেখা তাহার আয়ু পরিমাণ করে।
৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
গাছের লিখনভঙ্গী ব্যাখ্যা অনেক সময়-সাপেক্ষ। তবে উত্তেজিত অবস্থায় সাড়া বড়ো হয়, বিমর্ষ অবস্থায় সাড়া ছোটো হয় এবং মুমূর্ষ অবস্থায় সাড়া লুপ্তপ্রায় হয়। এই যে সাড়ালিপি সম্মুখে দেখিতেছেন তাহা লিখিবার সময় আকাশ ভরিয়া পূর্ণ আলো এবং বৃক্ষ উৎফুল্ল অবস্থায় ছিল। সেইজন্য সাড়াগুলির পরিমাণ কেমন বৃহৎ! দেখিতে দেখিতে সাড়ার মাত্রা কোনো অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ ছোটো হইয়া গেল। ইতিমধ্যে যদি কোনো পরিবর্তন হইয়া থাকে তাহা আমার অনুভূতিরও অগোচর ছিল। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, সূর্যের সম্মুখে একখানা ক্ষুদ্র মেঘখণ্ড বাতাসে উড়িয়া যাইতেছে। তাহার জন্য সূর্যলোকের যে যৎকিঞ্চিৎ হ্রাস হইয়াছিল তাহা ঘরের ভিতর হইতে কোনোরূপে বুঝিতে পারি নাই; কিন্তু গাছ টের পাইয়াছিল, সে ছোট্ট সাড়া দিয়া তাহার বিমর্ষতা জ্ঞাপন করিল। আর যেই মেঘখণ্ড চলিয়া গেল অমনি তাহার পূর্বের ন্যায় উৎফুল্লতার সাড়া প্রদান করিল। পূর্বে বলিয়াছি যে, আমি বৈদ্যুতিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করিয়াছিলাম যে, সকল গাছেরই অনুভব-শক্তি আছে। এ কথা পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকেরা অনেক দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করিতে পারেন নাই। কিয়দ্দিন হইল ফরিদপুরের খেজুর বৃক্ষ আমার কথা প্রমাণ করিয়াছে। এই গাছটি প্রত্যুষে মস্তক উত্তোলন করিত, আর সন্ধ্যার সময় মস্তক অবনত করিয়া মৃত্তিকা স্পর্শ করিত। ইহা যে গাছের বাহিরের পরিবর্তনের অনুভূতিজনিত তাহা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছি। যে সকল উদাহরণ দেওয়া গেল তাহা হইতে বুঝিতে পারিবেন যে, বৃক্ষলিখিত সাড়া দ্বারা তাহার জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে। গাছের পরীক্ষা হইতে জীবন সম্বন্ধে এইরূপ বহু নূতন তথ্য আবিষ্কার সম্ভবপর হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক সত্য ব্যতীত অনেক দার্শনিক প্রশ্নেরও মীমাংসা হইবে বলিয়া মনে হয়।
৬০. পাত্রাধার তৈল
শুনিতে পাই, কুকুরের লাঙুল আন্দোলন লইয়া দুই মতের এ পর্যন্ত মীমাংসা হয় নাই। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, কুকুর লেজ নাড়ে; অন্য পক্ষে বলিয়া থাকেন, লেজই কুকুরকে নাড়িয়া থাকে। এইরূপ পাতা নড়ে, কি গাছ নড়ে? তৈলাধার পাত্র কি পাত্রাধার তৈল? কে নাড়ায় আর কে সাড়া দেয়? বিলাতে আমাদের সমাজ লইয়া অনেক সমালোচনা হইয়া থাকে। এদেশে নাকি নারীজাতি নিজের ইচ্ছায় কিছু করিতে পারেন না, কেবল পুরুষের ইঙ্গিতে পুতুলের ন্যায় তাঁহারা চলাফেরা করিয়া থাকেন। কে কাহার ইঙ্গিতে চলে? রাশ কাহার হাতে? কে নাড়ায়, কুকুর কিংবা তাহার লেজ? ভুক্তভোগীরা যাহা যাহা বলেন তাহা অন্যরূপ। বাহিরে যতই প্রতাপ, যতই আস্ফালন, এ সকল পুতুলের নাচমাত্র, চালাইবার সূত্র নাকি অন্তঃপুরে। এমন সময়ও আসে যখন রমণী সেই বন্ধন-রজ্জু স্বীয় হস্তেই ছেদন করেন। অঞ্চল দিয়া যাহাকে এতদিন রক্ষা করিয়াছিলেন তাহাকেই আদেশ করেন- যাও তুমি দূরে, কেবল আশীর্বাদ লইয়া! তোমাকে মৃত্যুর হস্তেই বরণ করিলাম!