এই প্রাণীর দল কত ছোট তাহা তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি। ইহাদের চেয়ে ছোট যে-সকল উদ্ভিদ্ জলে জন্মে, তাহা খাইয়াই ইহারা বাঁচে। মানুষ মানুষকে খুন করে, ইহা আমরা জানি। লড়ায়ের সময়ে মানুষ যে কত মানুষকে মারিয়াছে, তাহার হিসাব হয় না। কিন্তু একজন মানুষের পেট ক্ষুধায় জ্বলিয়া উঠিলে, সে আর একটা মানুষকে ধরিয়া কামড়াইয়া খাইতেছে,—এ রকম কথা আমরা প্রায়ই শুনিতে পাই না। কিন্তু এক-কোষ প্রাণীরা কাছে খাবার না পাইলে তাহাদের জাত-ভাইদের ধরিয়া খাইয়া ফেলে। এই রকমে পরস্পর খাওয়া-খায়ি করিবার জন্য তাহাদের মধ্যে প্রায়ই লড়াই বাধে। গুগ্লি এবং শামুক বড় প্রাণী। ক্ষুধা পাইলে এক-কোষ প্রাণীরা এই সকল বড় বড় প্রাণীদিগকেও ছাড়ে না,—ইহাদের গায়ে লাগিয়া শরীরের রস চুষিতে আরম্ভ করে।
বাতাস না পাইলে কোনো প্রাণীই বাঁচে না। বাতাসে কি কি জিনিস আছে, তোমরা জান কি? ইহাতে নাইট্রোজেন্ নামে এক রকম বাষ্প আছে, এবং অক্সিজেন্ নামে আরো একটা বাষ্প আছে। মোটামুটি এই দুইটা জিনিস লইয়াই বায়ু প্রস্তুত। নাইট্রোজেনের কোনো রকম রঙ্ নাই, অক্সিজেনেরও কোনো রঙ্ নাই। যদি রঙ্ থাকিত, তাহা হইলে আমরা যেমন কুয়াসার আসা-যাওয়া চোখে দেখিতে পাই, বাতাসেরও আসা-যাওয়া চোখেই দেখিতে পাইতাম। যাহা হউক, বাতাসে যে নাইট্রোজেন্ বাষ্প আছে, তাহা প্রাণীর জীবন-রক্ষার জন্য প্রত্যক্ষ কোনো কাজে লাগে না—বাতাসের অক্সিজেন্টাই প্রাণীর শরীরের জন্য সর্ব্বদা দরকার। এই-জন্যই বাতাস না পাইলে প্রাণীরা বাঁচে না। আমরা কি রকমে বাতাসের অক্সিজেন্ শরীরের ভিতরে লই,—তোমরা জান না কি? আমরা নাক মুখ দিয়া বাতাস টানিয়া, তাহা শরীরের ভিতরকার ফুস্ফুসে লইয়া যাই, সেখানে বাতাসের অক্সিজেন্ শরীরের রক্তের সঙ্গে মিশিয়া যায়। ইহাতে রক্ত পরিষ্কার হয়, শরীরে বল হয়, জীবনের কাজ নির্ব্বিঘ্নে চলে এবং আরো কত কি হয়। নাক-মুখ দিয়া বাতাস লওয়া বন্ধ করিলে, ঐ-সকল কাজও বন্ধ হইয়া যায়, তখন মানুষ মারা যায়। তোমরা ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যার কথা নিশ্চয়ই পড়িয়াছ। একটা খুব ছোট ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করিয়া সেখানে অনেক লোককে কয়েদ করা হইয়াছিল,—এক রাত্রিতেই কয়েদিদের অনেকেই মরিয়া গিয়াছিল। বাতাস না পাওয়াতেই এই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল।
তোমরা বোধ হয় ভাবিতেছ, বাতাস যদি প্রাণীদের এত দরকার, তবে জলের মাছ ও গুগ্লিরা বাতাস না টানিয়া কি রকমে বাঁচে? এই প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। বাতাস যে, কেবল মাটির উপরে ও আকাশেই আছে, তাহা নয়। জলও অনেক বাতাস শুষিয়া রাখিতে পারে; এই জন্য নদী, সমুদ্র ও খালবিলের জলের সঙ্গে অনেক বাতাস মিশানো থাকে। মাছ ও অন্য জলচর প্রাণীরা জলে মিশানো বাতাসের অক্সিজেন্ বাষ্প টানিয়া লইয়া বাঁচিয়া থাকে। এক-কোষ প্রাণীদেরও বাঁচিয়া থাকার জন্য অক্সিজেনের দরকার। ইহারাও ঠিক্ মাছের মত করিয়া জলে মিশানো বাতাস হইতে অক্সিজেন্ টানিয়া লয়। কিন্তু অক্সিজেন্ টানিয়া লইবার জন্য যেমন মানুষ ও বড় বড় স্থলচর প্রাণীদের শরীরে ফুস্ফুস্ আছে এবং জলচর প্রাণীদের “কানকো” আছে, এক-কোষ প্রাণীদের শরীরে সে-রকম কিছুই নাই। ইহাদের যেমন নাক কান মুখ পেট কোনো অঙ্গই নাই, সেই রকম নিশ্বাস লইবারও যন্ত্র নাই। ইহারা সকল শরীর দিয়া জলের বাতাসের অক্সিজেন্ টানিয়া বাঁচিয়া থাকে। এই অক্সিজেনই তাহাদের খাদ্য পরিপাক করে এবং শরীর পুষ্ট করে। এক-কোষ প্রাণীদের দেহে এক বিন্দু রক্ত দেখিতে পাওয়া যায় না, কাজেই হৃদ্পিণ্ডের দরকার হয় না।
প্রাণীদের মধ্যে কেহ স্ত্রী, কেহ পুরুষ হইয়া জন্মে। কিন্তু এক-কোষ প্রাণীদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নাই। ইহাদের সকলি অদ্ভুত। যে রকমে ইহাদের সন্তান জন্মে, তাহা আরো অদ্ভুত। ভালো করিয়া খাওয়া-দাওয়া করার পরে শরীর মোটা ও পুষ্ট হইলেই, এই প্রাণী নিজের দেহটিকে দুই ভাগে ভাগ করিয়া ফেলে। এই রকমে একটি প্রাণী দুইটি হইয়া দাঁড়ায় এবং পরে আবার এই দুইটি প্রাণীই শরীর ভাঙিয়া ভাঙিয়া আরো নূতন প্রাণীর সৃষ্টি করিতে থাকে। এক-কোষ প্রাণীর সেই আঠার মত দেহটিকে নাড়িয়া চাড়িয়া তোমরা যদি তাহার কোষ-সামগ্রীকে খণ্ড খণ্ড করিয়া দাও, তবে দেহের প্রত্যেক খণ্ড হইতে এক-একটা নূতন প্রাণীর সৃষ্টি হইবে। তোমরা দ্বিতীয় চিত্রটিকে আর একবার দেখ। একটি আমিবা কি প্রকারে নিজের দেহ বিভক্ত করিয়া দুইটি হইয়াছে, চিত্র দেখিলে তাহা বুঝিবে। ইহারা যেন রক্তবীজের ঝাড়,—মৃত্যু নাই। কিন্তু মাছ বা অন্য ছোট জলচর প্রাণীদের কাছে ইহাদের হার মানিতে হয়। মাছেরা কাছে পাইলেই এক-কোষ প্রাণীদিগকে গিলিয়া ফেলে,—তখন তাহাদের আর রক্ষা থাকে না।
যাহাই হউক, এক-কোষ প্রাণীদের জীবনের কাজ এবং তাহাদের সন্তান-উৎপাদন সকলি অদ্ভুত।
খড়িমাটির পোকা
যে-সব প্রাণীর শত্রু বেশি, তাহারা ক্রমে নিজের শরীর বদলাইয়া শত্রুকে ফাঁকি দেয়। সজারু শরীরকে বড় বড় কাঁটা দিয়া ঢাকিয়া রাখে। কোনো শত্রু যদি তাহাকে ধরিতে আসে, তবে গায়ের কাঁটা দেখিয়া কাছে ঘেঁষিতে পারে না। শত্রু আসিতেছে জানিলেই, শামুক তাহার সমস্ত শরীর পিঠের উপরকার সেই শক্ত খোলের ভিতরে টানিয়া লয়। ইহাতে শত্রুর মুখে ছাই পড়ে। এ সম্বন্ধে আগেই তোমাদের কিছু বলিয়াছি।