সাধারণ শামুক-গুগ্লিকে ডাঙায় উঠাইয়া রাখিলে, খোলার ঢাক্নিগুলিকে তাহারা জোরে বন্ধ করিয়া দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে খোলার ভিতরে খানিকটা জলও আট্কাইয়া রাখে। এই আবদ্ধ জলের অক্সিজেন্ টানিয়া ইহারা ডাঙার উপরেও দুই এক দিন বাঁচিয়া থাকিতে পারে। তোমরা জল হইতে গুগ্লি উঠাইয়া খোলার ঢাক্নি খুলিয়া পরীক্ষা করিয়ো,—দেখিবে খোলার ভিতরে অনেকটা জল জমা আছে।
শামুকজাতীয় সকল প্রাণীই জলে বাস করে না। ডাঙায় জন্মিয়া এবং ডাঙার গাছপালা খাইয়া জীবন ধারণ করে, এ-রকম শামুকও অনেক দেখা যায়। ইহাদিগকে জলে ফেলিয়া দিলে বাঁচে না। নদীয়া, চব্বিশ পরগণা, হুগলি প্রভৃতি জেলায় কিছু দিন এক রকম বড় ডাঙার শামুকের ভয়ানক উপদ্রব হইয়াছিল। ইহাদের জ্বালায় বাগানের গাছপালা রাখা যাইত না। তোমরা এই রকম ডাঙার শামুক হয় ত দেখিয়াছ। ইহারা আমাদেরি মতো চিত্র ৭৬—ডাঙার শামুক। ফুস্ফুস্ দিয়া নিশ্বাসের কাজ চালায়। যদি ইহাদের দেহ পরীক্ষা করিতে পার, তবে দেখিবে, ইহাদের ঘাড়ের কাছে একটা লম্বা ফাটাল আছে। ঐ ফাটাল দিয়া বাহিরের বাতাস তালে তালে ইহাদের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে। জলের শামুকদের মধ্যেও দুই এক জাতি এই রকমে নিশ্বাস লয়। আমাদের দেশের ডোবা ও ধানের ক্ষেতের অল্প জলে এক রকম শামুক দেখা যায়। ইহারা জল ও স্থল দু’জায়গাতেই চরিয়া বেড়ায়। তাহাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা ঠিক ঐরকমের। তোমরা বর্ষার শেষে এই শামুক ধরিয়া একটি পাত্রে রাখিয়া দিয়ো,—দেখিবে, সে মাঝে মাঝে পাত্রের উপর হইতে খোলার ভিতরে বাতাস ভরিয়া লইতেছে এবং কিছুক্ষণ জলে ভাসিয়া আবার ড়ব দিতেছে। বাতাসে খোলা ভর্ত্তি থাকিলে দেহটা হাল্কা হয়। তাই তখন ইহারা অনায়াসে ভাসিতে পারে।
আমরা এ-পর্য্যন্ত কেবল পুষ্করিণী ও ডাঙার শামুকদের কথা বলিলাম। এখন তোমাদিগকে সমুদ্রের শামুকদের কথা বলিব। কড়ি ও বাজাইবার শাঁখ তোমরা দেখিয়াছ। এগুলি সমুদ্রের শামুকদের গায়েরই খোলা। তোমরা যে শাঁখ বাজাও, তাহা একবার পরীক্ষা করিয়ো। দেখিবে, শঙ্খের খোলা ঠিক গুগ্লি বা শামুকের খোলার মত নয়। ইহার এক দিক্টা যেন সরু হইয়া নলের মত হইয়াছে। কড়ি পরীক্ষা করিলেও তোমরা তাহাই দেখিতে পাইবে, কিন্তু কড়ির খোলা লেজের মত সরু হইয়া আসে না। ইহার এক প্রান্ত যেন একটু কাটা থাকে। সমুদ্রের শামুকদের খোলায় এই সরু অংশের প্রয়োজন কি, তাহা বোধ হয় তোমরা জান না। উহাদের গায়ের পর্দা নলের আকারে ঐ পথ দিয়া দেহের বাহিরে আসে। শঙ্খেরা ঐ পথ দিয়া দেহের ভিতরে জল প্রবেশ করায়। এই রকমে জলে-মিশানো বাতাসের অক্সিজেন্ টানিয়া লইয়া উহারা বাঁচিয়া থাকে।
শঙ্খ বা কড়ি দেখিতে সুন্দর। কিন্তু যখন জীবন্ত থাকে, তখন ইহাদের দেখিয়া ছোট জলচর প্রাণীরা ছুটিয়া পলাইয়া যায়। আমাদের পুষ্করিণীর শামুক-গুগ্লিরা শেওলা বা জলের পচা জিনিস খাইয়া বাঁচিয়া থাকে। কিন্তু শঙ্খের দল মাংস ভিন্ন অন্য কিছু খায় না। সমুদ্রের ছোট শামুক বা ঝিনুকরা উহাদের অত্যাচারে অস্থির হইয়া পড়ে। চিত্র ৭৭—কড়ি। ছুতোর মিস্ত্রিরা আগর দিয়া কি রকমে কাঠে ছিদ্র করে, তোমরা বোধ হয় তাহা দেখিয়াছ। মিস্ত্রিরা এই যন্ত্র দিয়া খুব শক্ত কাঠেও অল্প সময়ের মধ্যে ছিদ্র করিয়া দিতে পারে। শঙ্খদের মুখে আগরের মত এক একটা শুঁড় লাগানো থাকে। ইচ্ছা করিলে সেটিকে ইহারা হাতীর শুঁড়ের মত যে দিকে খুসী নাড়াইতে পারে। হাতীর শুঁড়ে দাঁত লাগানো থাকে না। শঙ্খের শুঁড়ের শেষে করাতের দাঁতের মত অনেক ধারালো দাঁত সাজানো থাকে। শামুক গুগ্লি, ঝিনুক বা খোলা-ওয়ালা অপর প্রাণী কাছে পাইলেই, তাহারা সেই শুঁড় দিয়া খোলাতে ছিদ্র করিয়া ফেলে এবং সেই ছিদ্রের ভিতর ঐ-সকল প্রাণীদের নরম মাংস খাইয়া ফেলে। শুঁড়ের ধার এত বেশি যে, তাহা দিয়া পাথরের মত শক্ত জিনিসেও ছিদ্র করা যায়। ঝিনুকের খোলার মত গোলাকার ছোট পাথর সমুদ্রের তলায় অনেক পড়িয়া থাকে। শঙ্খের দল ঝিনুক ভাবিয়া প্রায়ই এই সকল পাথরের গায়ে ছিদ্র করিয়া ফেলে। এই রকম ছিদ্রযুক্ত অনেক পাথর সমুদ্রের তলায় পাওয়া যায়। যাহা হউক শঙ্খদের শুঁড়ে কত ধার, তাহা একবার ভাবিয়া দেখ। ইহারা সামান্য প্রাণী নয়।
কড়ির গা কেমন চক্চকে, এবং তাহাতে কেমন সুন্দর রঙ্ লাগানো থাকে, তাহা তোমরা দেখিয়াছ। লক্ষ্মীপূজার সময়ে যে বড় বড় কড়ি সাজাইয়া রাখা হয়, দেখিলে মনে হয় যেন সেগুলিতে রঙ্ লাগাইয়া দেওয়া হইয়াছে। জীবন্ত কড়ির গায়ে একটা সরু চাম্ড়া লাগানো থাকে। এই জন্য উহাদের খোলায় কোনো আঘাত লাগিতে পারে না। ইহাতেই কড়ির উপরটা বেশ চক্চকে থাকে।
শামুক গুগ্লি, শঙ্খ ও কড়িদের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে। ইহাদের ডিম হইতে বাচ্চা বাহির হয়। কাহারো আবার দেহের মধ্যেই ডিম ফুটিয়া বাচ্চা বাহির হয়। কোনো কোনো জাতি, পতঙ্গদের মত নিরাপদ জায়গায় ডিম পাড়িয়া চলিয়া যায়। আবার কোনো শামুককে এক রকম থলিতে ডিম পাড়িতে দেখা যায়।
শামুক, গুগ্লি, শঙ্খ প্রভৃতির দেহের উপরে একটিমাত্র খোলা থাকে। গুগ্লি ও শামুকের খোলার এক-একটা ঢাক্নি থাকে বটে, কিন্তু ইহাকে খোলা বলা যায় না। ডাঙার শামুকদের খোলায় প্রায়ই ঢাক্নি দেখা যায় না। শীতকাল আসিলে শরীর হইতে এক রকম রস বাহির করিয়া ইহারা ঢাক্নি প্রস্তুত করিয়া লয় এবং শত্রুদের ভয়ে খোলা ও ঢাক্নি দিয়া সর্ব্বাঙ্গ ঢাকিয়া মড়ার মত পড়িয়া থাকে। তোমরা যদি খুব শীতের সময়ে ডাঙার শামুক কাছে পাও, তাহা হইলে উহার ঢাকনি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ো। দেখিলে মনে হইবে যেন শামুক মরিয়া গিয়াছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তাহা নয়। সমস্ত শীতকাল ধরিয়া ইহারা কিছুই খায় না। আগে বেশি রকমে খাইয়া যে বল সঞ্চয় করিয়া রাখে, তাহাতেই উহাদের জীবনের কাজ দুই তিন মাস অনায়াসে চলিয়া যায়, এবং ঢাক্নির ফাঁক দিয়া যে একটু বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে, তাহাতে নিশ্বাসের কাজও এক রকম চলিতে থাকে।