ঐ পর্দার গুণ বড় আশ্চর্য্যজনক। শামুক-গুগ্লিদিগকে বাচ্চা বেলায় মটর বা কলাইয়ের মত ছোট দেখায়। তখন ইহাদের গায়ের খোলাও খুব পাত্লা থাকে। যেমন বয়সের সঙ্গে দেহ বাড়ে, পর্দাগুলিও বড় হইয়া খোলার বাহিরে আসিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু এই সময়ে দেহের বৃদ্ধির সঙ্গে খোলা বড় হয় না। জলাশয়ের জল হইতে চূণ টানিয়া লইয়া ঐ পর্দাই খোলাগুলিকে বাড়াইতে আরম্ভ করে।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, পুকুর বা নদীর জলে আবার চূণ কোথায়? কিন্তু সকল জলে সত্যই অল্প পরিমাণে চূণ মিশানো থাকে। সকল মাটিতেই কম বা বেশি চূণ আছে। এই চূণই জলে গোলা থাকে।
দেহের বৃদ্ধির সঙ্গে কি-রকমে নূতন খোলার সৃষ্টি হয় তোমরা যদি একটি গুগ্লি বা শামুকের খোলা পরীক্ষা কর, তবে তাহা জানিতে পারিবে। গাছের গুঁড়ি করাত দিয়া চিরিলে কাঠের গায়ে যে গোলাকার দাগ সাজানো থাকে, তাহা হয় ত তোমরা দেখিয়াছ। গাছের গুঁড়ি প্রতিবৎসরে যেমন এক-একটু মোটা হয়, তেমনি কাঠে ঐ-রকম একএকটা দাগ রাখিয়া দেয়। শামুক-গুগ্লির খোলা গাছের মতই ধীরে ধীরে বাড়ে এবং অনেক সময়ে বাড়ার দাগও খোলার গায়ে আঁকা থাকে।
শঙ্খ ও কড়ি সমুদ্রের প্রাণী। কড়ি ছোট বড় কত রকমের হয় তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। গেঁটে কড়ির গায়ে গাঁটের মত উঁচু উঁচু অংশ থাকে। শঙ্খেরও ঐ-রকম নানা আকৃতি দেখা যায়। কোনো শঙ্খের খোলায় ঢেউ-খেলানো সুন্দর উঁচু উঁচু অংশ সাজানো দেখা যায়। কোনো শঙ্খের খোলা আবার শিঙের মত চূড়া-ওয়ালা দেখা যায়। শঙ্খের গায়ের খোলার এই বিচিত্র আকৃতি ভিতরকার সেই পাত্লা পরদার গুণেই হয়। আমাদের আঙুল ও হাত পায়ের তেলোর চাম্ড়া কেমন কোঁচ্কানো থাকে তাহা তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। কড়ি, গুগ্লি ও শঙ্খের গায়ের পর্দা ঐ-রকমে প্রায়ই কোঁচ্কাইয়া যায়। ইহাতে গায়ের উপরকার খোলাটিও ভিতরকার পর্দার মত কোঁচ্কাইয়া উৎপন্ন হইতে থাকে। তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, গায়ের পর্দা যে কেবল খোলাই উৎপন্ন করে তাহা নয়; খোলার বিচিত্র আকৃতিও ঐ পরদা দিয়া উৎপন্ন হয়।
মুক্তা খুব মূল্যবান্ জিনিস। মুক্তা যত বড় হয়, তাহার মূল্যও তত বাড়ে। কিন্তু জিনিসটা চূণ দিয়াই প্রস্তুত। ঝিনুকের শরীরের ভিতর মুক্তা হয়। আমরা ছেলেবেলায় গল্প শুনিয়াছিলাম, স্বাতী নক্ষত্রে বৃষ্টির জল হাতীর মাথায় পড়িলে গজমোতি হয় এবং ঝিনুকের গায়ে পড়িলে মুক্তা জন্মে। কিন্তু ইহা সত্য নয়। আমাদের গায়ের কোনো জায়গায় আঘাত লাগিলে যেমন সেইখানে রক্ত জমা হয়, ঝিনুকদের শরীরের ভিতরকার পর্দায় কোনো রকম উত্তেজনা আসিলে ঠিক সেইপ্রকারে রস বাহির হয়। এই রস জমাট বাঁধিয়া ক্রমে মুক্তা হইয়া দাঁড়ায়। বালির কণা বা অন্য কোনো ছোট জিনিস দেহের ভিতরে আট্কাইলেও পর্দার উত্তেজনা হয়।
আমাদের দেশের পুকুরের পাঁকের মধ্যে গুগ্লি পাওয়া যায়। কয়েকটি গুগ্লি ধরিয়া কাঁচের পাত্রের জলে ছাড়িয়া দিয়ো এবং জলের তলায় বালি ছিটাইয়া রাখিয়ো। এই অবস্থায় গুগ্লির অনেক চাল-চলন তোমরা দেখিতে পাইবে। ইহাদের মাথার উপরে শিঙের মত দুইটা শুঁয়ো থাকে এবং তাহারি পিছনে আরো দুইটি শুঁয়োর মাথায় দু’টা কালো চোখ থাকে। গুগ্লিদের পা নাই। দেহের তলাকার একখণ্ড চেপ্টা মাংসই ইহাদের পা। মাংসপিণ্ড হইলেও তাহাতে অনেক মাংসপেশী লাগানো থাকে এবং খোলার মধ্যেও একটা দড়ির মত মোটা মাংসপেশী লাগানো দেখা যায়। ইচ্ছা করিলেই ঐ-সকল পেশীর জোরে তাহারা মুখ চোখ পা এবং শুঁয়ো খোলার মধ্যে টানিয়া লইতে পারে।
ডাঙায় যে-সকল শামুক বেড়ায় তাহারা ধীরে ধীরে চলিতে থাকিলে পিছনে এক রকম ভিজে দাগ রাখিয়া যায়। তোমরা বোধ হয়, ইহা দেখিয়াছ। মুখের গ্রন্থি হইতে লালা বাহির হইয়া যেমন আমাদের মুখ ভিজাইয়া রাখে, ইহাদের শরীর হইতে সেই রকম লালার মত জিনিস পা ভিজাইয়া রাখে। এই লালা দিয়া তাহারা অনায়াসে পিছ্লাইয়া চলিতে পারে। জলের শামুক-গুগ্লির পায়ের তলা হইতেও ঐ রকম লালা বাহির হয়।
শামুক-গুগ্লিদের মুখ তোমরা দেখ নাই। ব্যাঙাচির মুখের মত ইহাদের মুখ মাথার নীচে থাকে। এই মুখে ছুঁচের মত অনেক দাঁত লাগানো আছে। খাবার জিনিষের উপরে চাপিয়া এই দাঁত দিয়া উহারা খাবার কাটিয়া খায়। বুড়ো হইলে আমাদের দাঁত পড়িয়া যায়, এবং দাঁতের ক্ষয়ও হয়। এই রকমে নষ্ট হইয়া গেলে আমাদের আর নূতন দাঁত গজায় না। তাই বুড়োরা শক্ত জিনিস খাইতে পারে না। শামুক-গুগ্লিদের দাঁত মানুষের দাঁতের মত শক্ত নয়। কাজেই শেওলা প্রভৃতি খাইতে খাইতে তাহাদের দাঁত শীঘ্রই ক্ষয় হইয়া যায়। কিন্তু দাঁত নষ্ট হইলে অন্য প্রাণীর যে রকম অসুবিধা হয়, ইহাদের তাহা হয় না। এক প্রস্ত দাঁত ক্ষয় হইলেই আর এক প্রস্ত দাঁত মুখে আসিয়া হাজির হয়। মজার ব্যাপার নয় কি?
যে ব্যবস্থায় নূতন দাঁত মুখে আসিয়া দাঁড়ায়, তাহা আরো মজার। শামুক-গুগ্লিরা অনেক ছোট দাঁত দেহের মধ্যে জড়াইয়া রাখে। ইহার খানিকটা নষ্ট হইয়া গেলেই আর খানিকটা তাজা দাঁত আপনা হইতেই বাহির হইয়া মুখে উপস্থিত হয়।
যাহারা জলে বাস করে তাহাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা কি রকম, তাহা তোমরা আগেই শুনিয়াছ। চিংড়ি মাছ জলে বাস করে। কান্কো দিয়া জলে-মিশানো অক্সিজেন্ টানিয়া ইহারা বাঁচিয়া থাকে। শামুক-গুগ্লিদের মধ্যে কয়েক জাতি ঐ-রকমে কান্কো দিয়া অক্সিজেন্ টানে, আবার কতক বড় প্রাণীদের মত ফুস্ফুস্ দিয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চালায়।