মাকড়সারা কি-রকমে পোকা শিকার করে, তোমরা কোনো জালের কাছে দাঁড়াইয়া দেখিয়ো। ইহারা শিকারের জন্য প্রায়ই জালের ঠিক্ মাঝখানটিতে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কখনো কখনো আবার জাল ছাড়িয়া কোনো পাতার আড়ালে লুকাইয়া অপেক্ষা করে। জাল হইতে দূরে থাকিলে জালের একটি সূতা প্রায়ই তাহাদের পায়ে লাগানো দেখা যায়। জালে পোকা পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে থাকিলে, সেই পায়ের সূতায় টান্ পড়ে। তখন মাকড়সারা বাঘের মত লাফাইতে লাফাইতে শিকারের ঘাড়ে চাপিয়া বসে।
পেটে ক্ষুধা থাকিলে মাকড়সাদের দিগ্বিদিক্ জ্ঞান থাকে না। তথন শিকারের ঘাড়ে চাপিয়াই তাহারা লম্বা দাঁত দিয়া শিকারকে মারিয়া ফেলে এবং দেহের ভিতরকার সারবস্তু শুষিয়া খাইয়া খোলাটা ফেলিয়া দেয়। যাহা দরকার তাহার চেয়ে বেশি কিছু পাইলে, আমরা তাহা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করিয়া রাখি। যাহারা বেশি টাকা উপার্জ্জন করে, তাহারা এই রকমে অনেক টাকা জমায় এবং চাষ-আবাদ করিয়া যাহারা বেশি ফসল পায়, তাহারাও এই রকমে গোলা গোলা ধান জমা করিয়া রাখে। পেট ভরা থাকিলে মাকড়সারা জালের পোকা-মাকড়দিগকে ঠিক্ ঐ-রকমেই জ্যান্ত অবস্থায় সঞ্চিত করিয়া রাখে। কুমরে-পোকা ও কাঁচপোকারা কি রকমে বাচ্চাদের জন্য পোকা-মাকড় ধরিয়া রাখে তাহা তোমরা জান। মাকড়সারা কতকটা সেই রকমেই ভবিষ্যতের জন্য জীবন্ত পোকা ধরিয়া রাখে। কিন্তু কুমরে-পোকাদের মত ইহারা শিকারের গায়ে হুল ফোটায় না। পেটের তলা হইতে সূতা বাহির করিয়া মাকড়সারা বড় বড় মাছি বা বোল্তার সমস্ত দেহটাকে এমন জড়াইয়া ফেলে যে, সেই সূতার বাঁধন ছিঁড়িয়া কেহই পলাইতে পারে না। তার পর যখন জালে পোকা আট্কায় না, তখন মাকড়সারা ঐ-সকল সূতা-জড়ানো বন্দী পোকাদের খাইতে আরম্ভ করে।
তোমরা কোনো মাকড়সার বড় জাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়ো। তখন দেখিবে, সাদা সূতা-জড়ানো দুই-একটি পোকার খোলা বা জীবন্ত পোকা জালের গায়ে লাগানে আছে। আমাদের ঘরের ভিতরে যে মাকড়সারা জাল বোনে, তাহারাও ভবিষ্যতের জন্য খাবার সঞ্চয় করে। ইহাদের জালে খোঁজ করিলেও তোমরা সূতা-জড়ানো পিঁপ্ড়ে বা মাছি দেখিতে পাইবে।
পিঁপ্ড়ে, মৌমাছি প্রভৃতি পতঙ্গদের পুরুষেরা কি রকম অকর্ম্মা তাহা তোমরা আগেই শুনিয়াছ। মাকড়সাদের পুরুষেরাও ঠিক্ সেই রকম অকেজো। ইহারা আকারে ছোট হইয়া জন্মে এবং প্রায়ই জাল বুনিতে পারে না। স্ত্রীরা যদি খাবার মুখের কাছে দেয়, তবেই ইহারা খাইতে পায়, নচেৎ ক্ষুধায় মরিয়া যায়। সুতরাং বুঝা যাইতেছে, আমরা জালের উপরে যে-সকল মাকড়সা দেখিতে পাই, তাহাদের মধ্যে প্রায়ই পুরুষ থাকে না। স্ত্রী-মাকড়সারাই জাল বোনে ও মশা-মাছি শিকার করে। যাহারা সংসারে কোনো কাজ না করিয়া কেবল পরের উপরে নির্ভর করে, ভবিষ্যতে তাহাদিগকে অনেক কষ্ট পাইতে হয়। পুরুষ-মাকড়সারা স্ত্রীদের উপরে নির্ভর করে বলিয়া ইহারাও শেষে বড় কষ্ট পায়। কিছুদিন একত্র থাকার পরে স্ত্রী-মাকড়সারা পুরুষদের উপরে এমন বিরক্ত হইয়া পড়ে যে, তাহাদিগকে আর কাছে ঘেঁসিতে দেয় না। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, তাই পদে পদে অপমানিত হইয়াও একটু খাবার পাইবার জন্য পুরুষেরা স্ত্রীর কাছ ছাড়া হইতে চায় না। তখন স্ত্রীরা পুরুষদের উপরে এত বিরক্ত হইয়া পড়ে যে, তাহারা একএকটি পুরুষকে ধরিয়া খাইতে আরম্ভ করে। এই রকমে পুরুষ-মাকড়সারা নিজেদেরি স্ত্রীর হাতে প্রাণ বিসর্জ্জন করে।
এখন আমরা মাকড়সার বাচ্চাদের কথা বলিব। পতঙ্গদের মত মাকড়সারাও ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম হইতে বাচ্চা হয়। ইহারা যে-রকমে ডিম পাড়ে, তাহা বড় মজার। প্রসবের সময় হইলে, স্ত্রী-মাকড়সারা শরীর হইতে সূতা বাহির করিয়া একএকটা থলি প্রস্তুত করে এবং তাহা পেটের তলায় রাখিয়া দেয়। শেষে প্রসবের পর ডিমগুলিকে সেই থলির মধ্যে রাখিয়া দেয়। একএকটা থলিতে কখনো কখনো ছয়-সাত শত ডিম জমা থাকে। আমাদের ঘরের ভিতরে যে-সকল মাকড়সা জাল বোনে, তাহাদের পেটের তলায় ঐ-রকম ডিমের থলি প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু বাহিরের ছোট মাকড়সারা এই রকম থলি পেটের তলায় রাখিয়া বিব্রত হইতে চায় না। তাহারা দেওয়ালের ফাটালে বা গাছের ছালের তলায় ডিমের থলি লুকাইয়া নিশ্চিন্ত থাকে।
মাকড়সাদের ডিম ফুটিয়া বাচ্চা বাহির হইতে অনেক সময় লাগে। কখনো কখনো তিন চারি মাস না গেলে ডিম হইতে বাচ্চা হয় না। পতঙ্গের বাচ্চারা নানা পরিবর্ত্তনের পরে সম্পূর্ণ আকার পায়। ইহা তোমরা জান। কিন্তু মাকড়সাদের ডিম হইতে যে বাচ্চা বাহির হয়, তাহা ছোট মাকড়সার আকারেই জন্মে। সুতরাং বলিতে হয়, ডিম হইতে বাহির হওয়ার পরে, ইহাদের চেহারার বিশেষ পরিবর্ত্তন হয়। না। কেবল বার বার গায়ের খোলস ছাড়িয়া ইহার আকারে বড় হয় মাত্র।
৬.৯.২ কাঁকড়া-বিছা
কাঁকড়া-বিছা
তোমরা হয় ত কাঁকড়া-বিছা দেখিয়াছ। ইহাকে কেহ কেহ বিচ্ছুও বলে। এখানে কাঁকড়া বিছার একটা ছবি দিলাম। কি বিশ্রী প্রাণী! দেখিলেই ভয় করে। তার পরে যদি কাছে আসিয়া গায়ে হুল ফুটাইয়া দেয়, তাহা হইলে সর্ব্বনাশ! ইহাদের হুলে ভয়ানক বিষ। কিন্তু ইহারা মাকড়সাদের দলেরই প্রাণী।