মাকড়সার চোখের কথা এখনো বলা হয় নাই। শরীর পরীক্ষা করিলে ইহাদের মাথার উপরে যে আটটি দাগ থাকে, সেইগুলিই উহার চোখ। পতঙ্গদের দুইটা চোখে যেমন হাজার হাজার ছোট চোখ থাকে, ইহাদের চোখে তাহা দেখা যায় না। মাকড়সাদের যে আটটি ছোট চোখ থাকে তাহা দিয়াই ইহার দেখার কাজ চালায়।
মাকড়সার লেজের কাছে যে কয়েকটি কালো দাগ দেখা যায়, সেই গুলিই মাকড়সার সূতা প্রস্তুতের ছিদ্র। এইগুলির তলায় সর্ব্বদাই এক রকম লালার মত জিনিস জমা থাকে। মাকড়সারা ঐ সকল ছিদ্র দিয়া সূতার মত করিয়া লালা বাহির করে। পরে বাতাসে শুকাইয়া শক্ত হইলেই তাহা দিয়া মাকড়সারা জল বোনার কাজ চালাইতে থাকে। এই ছিদ্রগুলির আকৃতি খালি চোখে ভালো দেখা যায় না। অণুবীক্ষণ বা বড় আতসী কাচে সেগুলিকে গোরুর বাঁটের মত দেখায়। মাকড়সার শরীরের তলায় এই রকম ছয়টা বাঁট থাকে। গোরুর প্রত্যেক বাঁটে একটার বেশি ছিদ্র থাকে না, কিন্তু মাকড়সার ছয়টা বাঁটের প্রত্যেকটিতে ঝাঝরির মত শত শত ছিদ্র থাকে। এই সকল ছিদ্র দিয়া মাকড়সারা অনেক সরু সূতা বাহির করে এবং সেগুলি একত্র করিয়া যে একটি সূতা হয়, তাহা দিয়া জাল বোনে। সুতরাং বুঝা যাইতেছে, মাকড়সার জালের সূতাগুলি একএকটি সূতা নয়,—অনেক সরু সূতা একত্র করিয়া এগুলি প্রস্তুত।
এখানে মাকড়সার একখানি পায়ের ছবি দিলাম। দেখ,—পায়ে যেন বাঘের নখের মত নখ রহিয়াছে। জালে শিকার পড়িলেই আটখানা পায়ের ঐরকম ধারালো নখ দিয়া তাহারা শিকারকে চাপিয়া ধরে। প্রত্যেক নখে যে চিরুণীর মত দাঁত লাগানো আছে, সেগুলি দিয়া ইহারা অনেক কাজ করে। কয়েকগাছি লম্বা সূতা জড়াইতে গেলে কি রকম বিপদে পড়িতে হয়, তাহা তোমরা জান। প্রায়ই সূতায় সূতায় গিঁট বাধিয়া যায়, কখনো আবার খেই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তখন ভয়ানক বিরক্তি লাগে এবং শেষে টানাটানি করিতে করিতে সূতায় সূতায় এমন জড়াজড়ি বাধিয়া যায় যে, সেগুলিকে আর পৃথক করা যায় না। মাকড়সারা যে-সকল সরু সূতায় জাল বোনে, তাহাতে জড়াজড়ি বাধার খুবই সম্ভাবনা থাকে। তাই উহারা নখের দাঁতগুলির ফাঁকে ফাঁকে সূতা বাধাইয়া জাল বোনে। ইহাতে সূতায় সূতায় গিঁট বাঁধিতে পায় না।
আমাদের মধ্যে অনেক রকম কারিগর আছে। কেহ কাঠের কাজ, কেহ কামারের কাজ, কেহ রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কিন্তু সকলেরই কাজ যে ভালো হয়, তাহা নয়। যে ছুতার কেবল ঢেঁকি তৈয়ারি করে, তাহার কাজের চেয়ে, যে চেয়ার-টেবিল তৈয়ারি করে, তাহার কাজ ভালো। কাজেই, ঢেঁকি-ওয়ালা ছুতারের চেয়ে চেয়ার-ওয়ালা ছুতার বেশি ওস্তাদ্। মাকড়সার মধ্যে এই রকম কাঁচা ও পাকা কারিগর দেখা যায়। আমাদের ঘরের কোণে ও কড়ি কাঠে যে মাকড়সারা জাল বোনে, তাহারা নিতান্ত কাঁচা কারিগর। কোনো-গতিকে কতকগুলি সূতা এদিকে ওদিকে আট্কাইয়া ইহারা জাল প্রস্তুত করে। এই সকল জালে কোনো কারিগুরি নাই। ঘাসের উপরে বা গর্ত্তের ভিতরে থাকিয়া এক রকম ছোট মাকড়সা যে জাল প্রস্তুত করে, তাহা তোমরা বোধ হয় দেখিয়াছ। রাত্রির শিশিরের জল সূতার উপরে জমা হইলে, এই জালগুলিকে প্রাতঃকালে মাটির উপরে স্পষ্ট দেখা যায়। ইহাতেও বিশেষ কারিগুরির পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু বাগানের গাছের ডালে মাকড়সারা চাকার মত যে ছোট-বড় জাল বোনে, তাহা দেখিলে বাস্তবিকই অবাক্ হইতে হয়। এই জালগুলিই মাকড়সার মধ্যে যাহারা পাকা কারিগর তাহারা প্রস্তুত করে।
পর পৃষ্ঠায় বাগানের মাকড়সাদের জালের একটা ছবি দিলাম। তোমরা একদিন ভোরে উঠিয়া বাগানে বেড়াইতে যাইয়ো। তখন দেখিবে, এক গাছ হইতে আর এক গাছে, বা এক ডাল হইতে আর এক ডালে, এই রকম জাল বাঁধিয়া ছোট মাকড়সা জালের ঠিক্ মাঝখানে বা বাহিরে বসিয়া আছে।
এই মাকড়সারা কি-রকমে জাল বোনে, তোমরা বোধ হয় তাহ৷ দেখ নাই। ইহারা এত তাড়াতাড়ি কাজ করে যে, তাহা দেখিলে অবাক্ হইতে হয়। দেড় হাত বা দুই হাত চওড়া জাল বুনিতে ইহারা কখনই এক ঘণ্টার বেশি সময় লয় না। উই পিঁপ্ড়ে বা মৌমাছির মত দলবদ্ধ হইয়া মাকড়সারা বাস করে না। কাজেই প্রত্যেক মাকড়সাকেই তাহার নিজের জাল নিজেই বুনিতে হয়। জাল বুনিবার সময়ে মাকড়সার বেশ একটি ভালো জায়গা বাছিয়া প্রথমে পেটের তলা হইতে একগাছি সূতা বাহির করে। হাল্কা সূতা দেহ হইতে বাহির হইয়া স্থির থাকে না। কিছুক্ষণ বাতাসে এদিকে ওদিকে নাড়াচাড়া করিয়া শেষে গাছের ডালে বা পাতায় লাগিয়া যায়। এই সূতায় জালের ভিত্ পত্তন হয়। মাকড়সারা ইহারি উপর দিয়া এক ডাল হইতে অন্য ডালে যাতায়াত আরম্ভ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক লম্বা সূতা ডালে ডালে যোগ করিতে থাকে। তার পরে এই সকল ফাঁক্ ফাঁক্ সূতার মাঝ-জায়গাটিকে কেন্দ্র করিয়া তাহারা চাকার মত গোলাকার জাল বুনিয়া ফেলে। তোমরা যদি পরীক্ষা কর, তবে দেখিবে, জালের টানা সূতাগুলি যত মোটা, গোলাকারে ঘুরানো সূতা সে রকম মোটা নয়; এইগুলিই সকলের চেয়ে সরু। মাকড়সারা পেটের তলার সেই ছিদ্র দিয়া ইচ্ছামত মোটা ও সরু সূতা তৈয়ার করিতে পারে।
কয়েকজাতীয় মাকড়সা আবার জালের সূতার গায়ে এক রকম আঠার মত জিনিস বিন্দু বিন্দু লাগাইয়া রাখে। এগুলি শীঘ্র শুকায় না। মশা মাছি প্রভৃতি জালে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতে থাকিলে সেই আঠা পোকাদের পায়ে ও ডানায় লাগিয়া যায়। কাজেই তাহারা আর পলাইতে পারে না।