এইবার আর্সুলার কথা বলিব। ইহারাও ফড়িংদের দলের প্রাণী। এখানে আর্সুলার একটা ছবি দিলাম। ইহাদের ছয়খানা পায়ের মধ্যে কোনোটাই ফড়িঙের পায়ের মত লম্বা নয়। এইজন্য আর্সুলারা লাফাইতে পারে না, খুব তাড়াতাড়ি দৌড়িয়া বেড়ায়। ইহাদের মুখ মাথার নীচে লাগানো থাকে, উপর হইতে মুখ দেখাই যায় না। যদি আর্সুলার মুখের আকৃতি দেখিতে চাও, তবে তোমরা ইহাকে চিৎ করিয়া ফেলিয়া দেখিয়ো। ইহাদের মাথার উপরকার শুঁয়ো দুটি ভয়ানক লম্বা হয়। আর্সুলারা নিশাচর প্রাণী; রাত্রির অন্ধকারে চারিদিক্ শুঁয়ো দিয়া ছুঁইতে ছুঁইতে চলা-ফেরার পথ আবিষ্কার করে।
আর্সুলার গায়ে তোমরা হাত দিয়া দেখিয়াছ কি? ইহাদের গা খুব তেলা। তাই ধরিতে গেলে প্রায়ই হাত হইতে ফস্কাইয়া যায় এবং দেওয়ালের সামান্য ফাটালের মধ্যে অনায়াসে প্রবেশ করিয়া লুকাইয়া থাকিতে পারে। যাহাদের ডানা হয় না, এ-রকম আর্সুলাও আছে। আমরা যে ছবিটি দিয়াছি, তাহা ডানাওয়ালা আর্সুলার ছবি। তোমাদের ভাণ্ডার ঘরে খোঁজ করিলে, এই রকম আর্সুলা অনেক দেখিতে পাইবে।
অন্য পোকা-মাকড় খাদ্যাখাদ্য বিচার করিয়া চলে, কিন্তু আর্সুলাদের সে বিচার-শক্তি নাই। পৃথিবীর কোনো জিনিসই ইহাদের অখাদ্য নয়। ভালো বাঁধানো বইয়ের পাতা ও মলাট ইহারা কি রকমে কুরিয়া থায়, তাহা তোমরা দেথ নাই কি? মানুষ অকাতরে রাত্রিতে ঘুমাইতেছে এবং আর্সুলারা আসিয়া ঘুমন্ত মানুষের আঙুলের মাংস ধীরে ধীরে কুরিয়া খাইতেছে, ইহাও আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি।
তোমরা হয় ত আর্সুলার ডিম দেখিয়াছ। যদি না দেখিয়া থাক, তবে তোমাদের ভাণ্ডার ঘরে খোঁজ করিয়ো;—দেখিবে, যেখানে আর্সুলা আছে তাহারি কাছে দেওয়ালের গায়ে সীমের বীজের মত লম্বা বাদামী রঙের কতকগুলি জিনিস আট্কানো আছে। এইগুলিই আর্সুলাদের ডিমের কোষ। আর্সুলারা ইহা প্রসব করিয়া দেওয়ালে বা বাক্স-পেটরার গায়ে আঠার মত একরকম জিনিস দিয়া আট্কাইয়া রাখে। এই কোষের ভিতরে উহাদের আট দশটা ডিম বেশ পৃথক্ ভাবে থাকে-থাকে সাজানো দেখা যায়।
ডিম ফুটিয়া বাচ্চা জন্মিলে, তাহারা আর কোষের ভিতরে থাকিতে চায় না। তখন মুখ হইতে এক রকম রস বাহির করিয়া তাহারা কোষের প্রাচীর গলাইয়া বাহিরে আসে।
আর্সুলার বাচ্চা তোমরা দেখ নাই কি? ইহারা ফড়িংদের মতই ডিম হইতে প্রায় সম্পূর্ণ আকারে বাহির হয়। তখন ইহাদের ডানা থাকে না। জন্মিয়াই ইহারা খুব খাইতে আরম্ভ করে এবং শীঘ্র আকারে বড় হইয়া বার-বার গায়ের খোলস ছাড়ে। যে-সকল জায়গায় বেশি আর্সুলা আছে, সেখানে তোমরা খোঁজ করিয়ো। দেখিবে, বাদামী রঙের আর্সুলা ছাড়া সেখানে অনেক সাদা রঙের আর্সুলাও আছে। ইহারাই সদ্য খোলস-ছাড়া আর্সুলা। পুরানো খোলস খসিয়া পড়িলে, উহাদের গায়ের নূতন আবরণটা ঐরকম সাদা দেখায়। যাহা হউক, আর্সুলারা পাঁচ-ছয় বার গায়ের খোলস বদ্লাইয়া বড় হইলে, তাহাদের ডানা গজায়। এই অবস্থাতেই তাহারা সম্পূর্ণ পতঙ্গ হইয়া দাঁড়ায়। যাহাদের ডানা হয় না, এই রকম আর্সুলাও কয়েক রকম দেখা যায়। ইহারা কিন্তু আকারে খুব বড় হয় না।
৬.৯.০ লূতা
লূতা
(Arachnids)
পতঙ্গদের কথা মোটামুটি শেষ করিলাম। এখন আগেকার কথা মনে কর। যষ্ঠ শাখার প্রাণীদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিয়াছিলাম। প্রথম ভাগে চিংড়ি মাছের দল ছিল এবং দ্বিতীয় ভাগে পতঙ্গেরা ছিল। এখন তৃতীয় ভাগের কথা তোমাদিগকে বলিব। এই দলের নাম লূতা-বর্গ—মাকড়সা কাঁক্ড়া-বিছা প্রভৃতি এই দলের প্রাণী।
পতঙ্গের দেহে মাথা, বুক ও লেজ এই তিনটা অংশ আছে। মাকড়সার দলে তাহা দেখা যায় না। সোজা কথায় বলিতে গেলে, ইহাদের দেহে মাথা ও লেজ এই দুইটি অংশ আছে। পতঙ্গদের দেহে ছয়খানা পা থাকে এবং অনেকের ডানাও দেখা যায়। মাকড়সার দলের প্রাণীদের ডানা থাকে না; মাথার অংশ হইতে আটখানা পা বাহির হয়।
৬.৯.১ মাকড়সা
মাকড়সা
তোমরা সকলেই মাকড়সা দেখিয়াছ। ইহারা ঘরের কোণে, বাগানের গাছে এবং কখনো কখনো ঘাসের উপরে জাল বুনিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। তার পরে মশা, মাছি প্রভৃতি ছোট পোকা জালে আট্কাইলে শিকারগুলিকে আক্রমণ করে। কি বিশ্রী চেহারা! উহাদের কয়খানি পা দেখিলেই ভয় করে। মাকড়সা গায়ের উপরে লাফাইয়া পড়িলে কি রকম অশান্তি হয়, তাহা তোমরা জান।
তোমাদের ঘরের কোণে যে মাকড়সাটি শিকার ধরিবার জন্য বসিয়া আছে, একবার সেটিকে ভালো করিয়া দেখিয়ো। তখন দেখিবে, তাহার দেহ দুই ভাগে বিভক্ত। সম্মুখের ভাগে মুখ ও আটখানা পা আছে। পিছনের ভাগে কেবল জাল বুনিবার জন্য সূতা প্রস্তুতের যন্ত্র আছে। পতঙ্গদের শরীর যেমন কতকগুলি আংটির মত নরম হাড় দিয়া প্রস্তুত, ইহাদের দেহ সে-রকম নয়। সমস্ত দেহ খুঁজিলেও মাকড়সার দেহে আংটির সন্ধান পাওয়া যায় না। ইহাদের দেহ খুব ছোট সরু লোমে ঢাকা থাকে; পায়েও লোম দেখা যায়। আতসী কাচ দিয়া পরীক্ষা করিলে তোমরা মাকড়সার গায়ের ও পায়ের লোম এবং লেজের দিকে সূতা প্রস্তুতের যন্ত্র দেখিতে পাইবে। কিন্তু দেহের কোনো জায়গায় ডানা খুঁজিয়া পাইবে না।
আমরা এখানে মাকড়সার একটি ছবি দিলাম। দেখ, ইহার দেহ সত্যই দুই ভাগে ভাগ করা আছে। সম্মুখের মুখের কাছে আরো দুখানি পায়ের মত যে অঙ্গ দেখিতেছ, তাহা পায়ের মত দেখাইলেও, পা নয় বা শুঁয়ো নয়। ইহাদের মুখের চোয়াল লম্বা হইয়া এই রকম হইয়াছে। মাকড়সারা যখন পোকা-মাকড় খায়, তখন ঐ চোয়াল দিয়া শিকারকে চাপিয়া ধরে এবং গায়ে দাঁত বসাইয়া তাহাদিগকে মারিয়া ফেলে। ইহাদের মুখের দাঁত ভয়ানক অস্ত্র। ভীমরুলের মত বলবান্ প্রাণীরাও এই দাঁতের আঘাতে মারা যায়। কেবল ইহাই নয়, মাকড়সাদের মুখে বিষের থলি থাকে। তাহাতে আপনা হইতেই বিষ জমা হয়। মাকড়সারা কোনো প্রাণীর গায়ে দাঁত ফুটাইবার সময় একটু বিষও ঢালিয়া দেয়। দাঁতের আঘাত ও বিষের জ্বালা সহ্য করিতে না পারিয়া সকল রকম পোকাই মারা যায়।