প্রাণীর বংশবৃদ্ধি
যে হারে প্রাণীদের বংশবৃদ্ধি হয়, তাহাও বড় অদ্ভুত। হাতী ঘন ঘন সন্তান প্রসব করে না। দশ বৎসর অন্তর ইহাদের এক-একটি শাবক হয়। একজন হিসাব করিয়া দেখিয়াছিলেন, পৃথিবীতে যদি কেবল এক জোড়া হাতী থাকিত, তবে তাহাদের বাচ্চায় এবং বাচ্চাদের বাচ্চায় মিলিয়া সাড়ে সাত শত বৎসরে পৃথিবীতে উনিশ লক্ষ হাতী হইয়া দাঁড়াইত। মাছের বংশ-বিস্তার আরও বেশি। আট-দশ সের ওজনের মাছ পৃথিবীর নদী-সমুদ্রে, খালে-বিলে যে কত আছে, তাহা ঠিক করা যায় না। হয় ত তোমাদের পুকুরেও খুঁজিলে দুই-চারিটি পাওয়া যায়। এই রকম মাছ বৎসরে প্রায় নব্বই লক্ষ ডিম ছাড়ে। একসের আধ-সের ওজনের মাছের কুড়ি হাজার হইতে সাতচল্লিশ হাজার পর্য্যন্ত ডিম হয়। ছোটো ইঁদুর তোমরা দেখিয়াছ। লেপ, বালিশ, কাগজপত্র সকলি কাটিয়া ইহারা ঘরে মহা উৎপাত করে। ইহাদের বংশবৃদ্ধির কথা শুনিলে তোমরা অবাক্ হইবে। বৎসরে ইহারা ছয়-সাত বার শাবক প্রসব করে এবং এক-একবারে ইহাদের ছয়টি হইতে উনিশটি পর্য্যন্ত বাচ্চা হয়। বাচ্চা ছোটো অবস্থায় মারা গেলে, কখনো কখনো মাসে মাসেই ইহারা গড়ে দশ-বারোটা বাচ্চা প্রসব করে। খরগোসের বাচ্চাও বড় কম হয় না। তোমাদের মধ্যে কেহ যদি সাদা খরগোস পুষিয়া থাক, তবে হয় ত তাহা স্বচক্ষেই দেখিয়াছ। বৎসরে ইহারা চারিবার শাবক প্রসব করে এবং প্রতিবারে প্রায় ছয়টা করিয়া বাচ্চা হয়।
এই ত গেল বড় জানোয়ারদের কথা। ছোটো প্রাণীদের বংশবৃদ্ধি আরো অধিক হয়। পতঙ্গ খুব ছোটো প্রাণী; ইহারা যেমন বেশি আহার করে, তেমনি বেশি সন্তান প্রসব করে। গোলাপ ফুলের গাছে এবং কফি প্রভৃতি তরকারির গাছে যে এক রকম ডানা-ওয়ালা সবুজ ছোটো পোকা হয়, তাহা বোধ হয় তোমরা দেখিয়াছ। বর্ষার শেষে এবং ফাল্গুনের সন্ধ্যায় এই পোকাদের উৎপাতে ঘরে আলো জ্বালা দায় হয়। দেওয়ালির রাত্রিতে ইহারা অলোকের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসিয়া দীপের শিখায় পুড়িয়া মরে। হক্স্লি সাহেব হিসাব করিয়া দেখিয়াছিলেন,—এই পোকার একটিতে যে সকল সন্তান উৎপন্ন করে, পুত্রপৌত্রাদিক্রমে তাহারা গ্রীষ্মের তিন-চারি মাসে চীনদেশের জনসংখ্যার সমান হইয়া দাঁড়ায়। পৃথিবীর সকল দেশের চেয়ে চীন দেশে বেশি লোক বাস করে। চীনে এখন প্রায় চল্লিশ কোটি লোকের বাস। একটা পোকায় যদি এত সন্তান প্রসব করিতে পারে, তবে তোমাদের বাগানের সমস্ত পোকারা মোট কত পোকা জন্মায় বলিতে পার কি? ইহার হিসাবই হয় না। তার পর মনে রাখিয়ো,—পৃথিবীতে যে কেবল তোমাদেরি বাগান আছে তা নয়। কত দেশের কত লক্ষ লক্ষ বাগানে ও কত বন-জঙ্গলে, কোটি কোটি সবুজ পোকা আছে, তাহাদের প্রত্যেকটি ঐ-রকমে সন্তান জন্ম দিয়া যাইতেছে।
মাছিরা গ্রীষ্মকালে কি-রকম উৎপাত করে, তাহা তোমরা জান। একটু বিশ্রাম করিতে গেলে মুখে চোখে ও কানে বসিয়া বিরক্ত করে, আহারের সময়ে খাবারের উপরে বসিয়া উৎপাত করে। ইহারা যে পরিমাণে সন্তান জন্মায় তাহাও অদ্ভুত। একটিমাত্র মাছি গ্রীষ্মের কয়েক মাসে এত ডিম প্রসব করে যে, সেগুলি হইতে নূতন মাছি জন্মিয়া পুত্র-পৌত্রাদিতে এক বৎসরে পাঁচ শত কোটি হইয়া দাঁড়াইতে পারে। পাখীদের বংশবৃদ্ধিও বড় অল্প নয়। এক জোড়া পাখী যদি চারিটি করিয়া শাবক শত্রুর হাত হইতে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে, তবে পনেরো বৎসর পরে তাহাদেরি বংশে দুই শত কোটি পাখী হইয়া দাঁড়ায়।
এত প্রাণী কোথায় যায়?
তোমরা বোধ হয় এখন মনে করিতেছ, যদি প্রাণীদের সত্যই এই প্রকারে বংশবৃদ্ধি হয়, তবে পোকা-মাকড় ইঁদুর, বিছে, ব্যাঙ্, হাতী, ঘোড়াতে আজও পৃথিবী পূর্ণ হয় নাই কেন? এই রকম প্রশ্ন মনে হওয়াই সঙ্গত। কিন্তু ইহার উত্তর কঠিন নয়। তোমরা যদি একটু খোঁজ কর, তবে দেখিবে,—যে-প্রাণী অধিক সন্তান প্রসব করে, তাহার সন্তানগুলির অধিকাংশই বড় হইবার পূর্ব্বে নানা রকমে মরিয়া যায়। সবুজ-পোকারা কত বেশি সন্তান উৎপন্ন করে তাহা তোমরা শুনিয়াছ। সেই সকল সন্তানদের অধিকাংশই অন্য পোকা এবং পাখীরা খাইয়া ফেলে; পরে কতক আবার শীতে রৌদ্রে বৃষ্টিতে ও ঝড়ে নষ্ট হইয়া যায়। এই প্রকার ক্ষয়ের পর যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাদের অনেকেই জলে বা আগুনে পড়িয়া মারা যায়; শেষে দেখা যায়, মোটের উপরে পোকার সংখ্যা বাড়ে নাই,—পুরানো পোকার দল মরিয়া গেলে, তাহাদের জায়গা পূরণ করিবার জন্য যতগুলি নূতন পোকার দরকার, কোটি কোটি নূতন পোকার মধ্যে কেবল ততগুলিই বাঁচিয়া আছে। কেবল সবুজ-পোকাদের মধ্যেই যে ইহা দেখা যায় তাহা নয়। এক-একটা মাছে কত ডিম প্রসব করে, তাহা তোমরা শুনিয়াছ। প্রত্যেক ডিম হইতেই যদি মাছ জন্মিত, তাহা হইলে পৃথিবীর নদী, সমুদ্র, খাল, বিল এক বৎসরেই মাছে পূর্ণ হইয়া যাইত। তােমরা জলে ডুব দিয়া যে স্নান করিবে, তাহারও উপায় থাকিত না। কিন্তু তাহা দেখা যায় না। ডিমের অধিকাংশই জলে থাকিয়া নষ্ট হইয়া যায়, কাজেই সেগুলি হইতে মাছ জন্মে না। আবার ডিম ফুটিয়া যে ছােটো ছােটো মাছ বাহির হয়, তাহাদেরও সকলগুলি শেষ পর্য্যন্ত বাঁচে না। নানা রকম বড় মাছ এবং অন্য জলচর প্রাণীরা সেগুলিকে খাইয়া ফেলে। শেষে দেখা যায়,—মোটের উপরে মাছের সংখ্যা বাড়ে নাই।