আমরা এ-পর্য্যন্ত যে-সকল প্রাণীর জীবনের কথা বলিলাম, তাহারা লোনা জলে থাকে না। পুকুর, খাল, বিল এবং নালাতেই ইহাদের বাস। কিন্তু সমুদ্রের লোনা জলেও এই শাখার প্রাণীর অভাব নাই। নানা আকার ধরিয়া এই প্রাণীদেরই নানা জাতি সমুদ্রের সকল অংশে চলাফেরা করে। ইহাদের কাহাকেও জেলি মাছ, কাহাকেও মেডুসা ইত্যাদি নানা নাম দেওয়া হয়। পুরীর সমুদ্রের ধারের লোকেরা এই রকম এক প্রাণীকে রাবণচ্ছত্র নাম দিয়াছে। শুঁয়োগুলিকে জলের নীচে রাখিয়া ইহারা মাথায় দিবার ছাতির মত সমুদ্রের জলে ভাসিয়া বেড়ায়। তার পরে, কাছে ছোট মাছ বা জলের পোকা পাইলেই শুয়োঁ জড়াইয়া সেগুলিকে মুখে পুরিয়া দেয়। এক-একটি প্রাণী লইয়া এই ছত্র হয় না; একই জাতির অনেক প্রাণী মিলিয়া এক একটা ছত্র নির্ম্মাণ করে। এখানে রাবণচ্ছত্রের একটা ছবি দিলাম। দেখিতে ঠিক ছাতার মত নয় কি? তোমরা যদি কখনো কলিকাতার মিউজিয়ম্ অর্থাৎ যাদুঘর দেখিতে যাও, তবে সমুদ্রের এই সকল প্রাণীদের চেহারা দেখিতে পাইবে। নানা জায়গা হইতে এই শাখার অনেক প্রাণী জোগাড় করিয়া সেখানে বোতলের মধ্যে পুরিয়া রাখা হইয়াছে। সমুদ্র হইতে আমরা অনেক দূরে বাস করি, কাজেই জীবন্ত অবস্থায় এই প্রাণীদিগকে দেখা আমাদের ভাগ্যে হঠাৎ ঘটিয়া উঠিবে না।
৩.৩ প্রবাল
প্রবাল
তোমরা হয় ত প্রবাল দেখিয়া থাকিবে। জিনিষটা দেখিতে সিঁদুরের মত লাল এবং পাথরের মত শক্ত। লোকে প্রবালের মালা গাঁথিয়া গলায় পরে এবং সৌখিন লোকেরা ইহা সোনার আংটিতে বসাইয়া ব্যবহার করে। কিন্তু সকল প্রবালই লাল নয়; হাড়ের মত সাদা প্রবালও দেখা যায়। এই জিনিষটা কোথায় ও কি প্রকারে উৎপন্ন হইল, তাহা খোঁজ করিলে দেখা যায়, হাইড্রার মত এক জাতি প্রাণীই ইহা উৎপন্ন করে। স্পঞ্জ্ যেমন এক রকম প্রাণীর বাসা, প্রবালও আর এক রকম প্রাণীর বাসা।
এখানে প্রবাল-প্রাণী ও তাহাদের ঘরের একটা ছবি দিলাম। এক একটি হাইড্রা যেমন পৃথক্ হইয়া বাস করে, প্রবাল-প্রাণীদের সে-রকমে থাকিতে দেখা যায় না। একই জায়গায় ইহারা হাজারে হাজারে একত্র বাস করে, এবং তাহাদের সন্তান-সন্ততি সেই জায়গা ছাড়িয়া দুরে যায় না। ছবিতে যেগুলিকে গাছের ডালের মত দেখিতেছ, তাহাদের প্রত্যেকটিই এক একটি প্রবাল-প্রাণীর বাসা। জীবন্ত প্রাণীগুলি ছবির ডালের মাথায় শুঁয়ো বাহির করিয়া আছে।
এক-কোষ প্রাণীরা কি রকমে গায়ের চারিদিকে খোলা প্রস্তুত করে, তাহা অাগে শুনিয়াছ। ইহারাও সেই প্রকারে সমুদ্রের জল হইতে চূণ টানিয়া লইয়া পাথরের মত শক্ত বাসা তৈয়ার করে। এই রকমে অনেক প্রাণী গায়ে গায়ে বাসা করিতে থাকিলে, সেগুলি কিছুকাল পরে প্রবালের মোটা থামের মত হইয়া পড়ে। তার পরেও যখন হাজার হাজার প্রাণী তাহারি উপরে বাসা করিতে আরম্ভ করে, তখন সমস্ত জিনিসটা সমুদ্রের তলার প্রকাণ্ড গাছের মত হইয়া দাঁড়ায়।
লাল প্রবালের চেয়ে সমুদ্রের তলায় সাদা প্রবাল অধিক পাওয়া যায়। সাদা প্রবালের প্রাণীরা নানা রকম আকৃতির ঘর প্রস্তুত করে। এখানে ইহাদের এক রকম ঘরের ছবি দিলাম। ইহা দেখিলে, মনে হইবে, যেন, জিনিসটা বাতাস খাইবার হাত-পাখা। কিন্তু ইহার আগাগোড়া সাদা প্রবালে তৈয়ারি এবং পাথরের মত শক্ত।
ঠাণ্ডা দেশের সমুদ্রে প্রবাল জন্মে না। যে-সকল দেশে শীত কম, সেখানকার সমুদ্রতলে গাছের মত অসংখ্য প্রবাল-প্রাণীদের বাসা দেখা যায়। আমাদের ভারত-মহাসাগর এবং ভূমধ্য-সাগর ইহাদের প্রধান বাস-স্থান। শত শত বৎসর ধরিয়া একই জায়গায় বাসা করায়, প্রবাল-প্রাণীদের ঘরগুলি এক একটি ছোট-খাটো পাহাড়ের মত হইয়া পড়ে। তার পরে এই সকল প্রবালের পাহাড়ের গায়ে মাটি জমিতে আরম্ভ করিলে, সেগুলি এক একটি দ্বীপ হইয়া দাঁড়ায়। এই রকম প্রবালের দ্বীপ পৃথিবীতে অনেক জায়গায় দেখা যায়। আমাদের ভারতবর্ষের কাছে যে মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ আছে তাহার কথা হয় ত তোমরা ভূগোলে পড়িয়াছ। এই দ্বীপগুলি গোড়ায় প্রবাল-প্রাণীদের বড় বড় বাসা ছিল; পরে তাহারি গায়ে মাটি জমিয়া এখন বড় বড় দ্বীপের সৃষ্টি হইয়াছে। এই সকল দ্বীপের উপরে এখন চাষ আবাদ হইতেছে—মানুষ, পশু বাস করিতেছে। সুতরাং বুঝা যাইতেছে, প্রবাল-প্রাণীরা সমুদ্রের মধ্যে নূতন নূতন ডাঙা জমি প্রস্তুত করিয়া মানুষের অনেক উপকার করে।
৪. তারা-মাছ – স্নায়ুমণ্ডলী
চতুর্থ শাখার প্রাণী
এ-পর্য্যন্ত যে-সব প্রাণীদের কথা বলা হইল, তাহাদের মধ্যে প্রথম প্রাণীদের শরীরে এক একটি করিয়া কোষ থাকে ইহা তোমরা শুনিয়াছ। ইহার পরে যে-সকল প্রাণীদের কথা বলিয়াছি, তাহারা অনেক কোষ দিয়া শরীর নির্ম্মাণ করে, ইহাদের জীবনের কথা তোমরা শুনিয়াছ। এই দুই শাখার প্রাণীর উদর বা পাকযন্ত্র নাই, জলের ভিতরে শেওলার গায়ে ইহারা জড়ের মত বাস করে। কাছে যদি খাদ্য আসে, তবে সর্ব্বশরীর দিয়া তাহার সার অংশ চুষিয়া খায়। ইহাদের চোখ, কান, নাক কিছুই নাই, কাজেই কিছু দেখিতে বা শুনিতে পায় না। কিন্তু তৃতীয় শাখার প্রাণীরা এই রকম জড়ের মত বাস করে না। তাহাদের দেহে অনেক কোষ। আমাদের দেহের কতক কোষ একত্র হইয়া যেমন শরীরের জায়গায় জায়গায় চোখ, কান, নাক ইত্যাদি তৈয়ার করে, তৃতীয় শাখার প্রাণীদের শরীরের কোষ সেই রকমে ভাগ ভাগ হইয়া কেহ শুঁয়ো, কেহ পাকযন্ত্র গড়িয়া তোলে, আবার কতকগুলি মিলিয়া সন্তান উৎপাদনের জন্য ডিমও নির্ম্মাণ করে। ইহাও তোমরা শুনিয়াছ।