হাইড্রার শুঁয়োগুলি সাধারণত চিকণ চুলের চেয়ে অধিক মোটা হয় না। এজন্য ইহার খুঁটিনাটি সব দেখিতে হইলে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হয়। তোমরা যদি পুকুরের হাইড্রার একগাছি শুঁয়ো লইয়া অণুবীক্ষণে পরীক্ষা করিয়া দেখ, তবে উহার গায়ে গাঁটের মত কতকগুলি উঁচু উঁচু অংশ দেখিতে পাইবে। এইগুলিতে এক রকম বিষে পূর্ণ থাকে এবং তাহারি মধ্যে হাইড্রারা এক রকম সরু ফাঁস ঘড়ির স্প্রীঙের মত গুটাইয়া রাখে। এই ফাঁসগুলিও নলের মত, ইহাদের ভিতর ফাঁপা।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, এই বিষের কোষগুলি বুঝি খুবই বড় জিনিস। কিন্তু তাহা নয়, এই কোষের তিন চারিশত সারি করিয়া সাজাইলে, তবে সকলগুলিতে মিলিয়া কেবল এক ইঞ্চি লম্বা হইতে পারে। সুতরাং এত ছোট কোষের মধ্যে যে-সকল ফাঁস লুকানো থাকে, সেগুলি কত সরু, তাহা তোমরা ভাবিয়া দেখ।
আমরা এখানে হাইড্রার শুঁয়োর গায়ের বিষ-কোষের একটা ছবি দিলাম। ছবিটি অনেক বড় করিয়া আঁকা হইয়াছে। বিষের মধ্যে ফাঁস কেমন গুটানো আছে, ছবি দেখিলেই তোমরা বুঝিবে।
এখন এই বিষ ও ফাঁস দিয়া হাইড্রারা কি রকমে ছোট প্রাণী শিকার করে তাহা বলিব। জলে হাইড্রারা শেওয়ালার গায়ে বা জলের গাছ-পালার গায়ে দেহ আট্কাইয়া চুপ করিয়া থাকে। কিন্তু অন্য জলচর প্রাণীরা সে-রকমে থাকে না, তাহারা তাড়াতাড়ি সাঁতরাইতে পারে; কাজেই জলের ভিতরে তাহারা ক্রমাগত ছুটাছুটি করে। এই রকম দুটাছুটি করিতে করিতে যদি হঠাৎ তাহারা হাইড্রার গায়ে ধাক্কা দেয়, তবে আর রক্ষা থাকে না। খাবার জিনিস গায়ে ঠেকিলেই হাইড্রাদের শুঁয়োর গায়ের সেই কোষের বিষ ফাঁসের নলের ভিতরে প্রবেশ করে। ইহাতে সেগুলি খাড়া হইয়া উঠে। তার পরে, বিষে-ভরা ফাঁসগুলি শিকারকে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার গায়ে এমন বিষ ঢালিতে আরম্ভ করে যে, শিকার জখম হইয়া পড়ে, তখন তাহার আর পালাইবার উপায় থাকে না।
শিকার ধরিয়া খাইবার এমন সুব্যবস্থা আছে বলিয়াই, খাদ্য জোগাড় করার জন্য হাইড্রাদের বেশি চলা-ফেরা করিতে হয় না। তাহারা টোপা-পানা, পদ্মের পাতা, শেওলার গায়ে শরীর আট্কাইয়া প্রায় ঝুল খাইয়াই জীবন কাটায়।
আমরা আগেই বলিয়াছি, হাইড্রাদের শরীর এক একটা প্রকাণ্ড নলের মত; তাহার সমস্তটাই ফাঁপা। খাদ্য পাইলেই তাহারা ফাঁপা শরীরে ভিতরে প্রবেশ করায় এবং সেখানে তাহা পরিপাক করে। আমরা পর পৃষ্ঠায় হাইড্রার উদরের একটা ছবি দিলাম। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যে-রকম দেখা যায়, ছবিটি সেই রকমের। ছবিটি দেখিলেই বুঝিবে, হাইড্রার পেট অনেক ছোট ছোট কোষে আচ্ছন্ন। খাদ্য পেটে পড়িলেই ঐ-সকল কোষ হইতে এক রকম রস বাহির হয় এবং তাহাই খাদ্য হজম করে। তার পরে মাছের কাঁটা বা পোকাদের গায়ের খোলা প্রভৃতি যে সকল অখাদ্য জিনিস পেটের ভিতরে যায়, তাহা হাইড্রারা মুখ দিয়া উগ্রাইয়া ফেলে। ইহাদের শরীরে মুখ ছাড়া আর দ্বিতীয় পথ নাই।
দেখ, খাদ্য হজম ব্যাপারেও ইহারা কত উন্নত। গোরু, ছাগল, মানুষ প্রভৃতি বড় বড় প্রাণীদেরও পেটের ভিতরটা ঐরকমেই কোষে আচ্ছন্ন থাকে এবং তাহা হইতে নানা রকম রস বাহির হইয়া খাদ্য হজম করে। বড় প্রাণীদের শরীরের কাজের সহিত ইহাদের জীবনের কাজের অনেক মিল আছে বলিয়াই, হাইড্রারা তৃতীয় শাখার প্রাণী হইয়াছে।
বড় বড় প্রাণীদের মধ্যে যেমন কতকগুলি পুরুষ এবং কতক স্ত্রী হইয়া জন্মে, হাইড্রারা সে-রকমে জন্মে না। ইহাদের সকলেই সন্তান উৎপন্ন করে। গ্রীষ্মকালে ইহারা খুব সতেজ থাকে। তেজালাে গাছে যেমন শীঘ্র শীঘ্র ডালপালা গজাইয়া উঠে, সতেজ হাইড্রাদের দেহ হইতে সেই রকমে ফুলের কুঁড়ির মত অনেক কুঁড়ি ঐ সময়ে আপনা হইতেই উৎপন্ন হয়। সেগুলি কিছু দিন উহাদের গায়েই আট্কাইয়া থাকে, তার পরে আপনিই জলের তলায় পড়িয়া যায়। এই ঝরা কুঁড়িগুলিই হাইড্রাদের সন্তান। ইহারাই শরীর হইতে ক্রমে শুঁয়াে বাহির করে এবং শেষে হাইড্রা হইয়া দাঁড়ায়।
খুব শীতের সময়ে হাইড্রারা যখন মড়ার মত নিস্তেজ হইয়া পড়ে, তখন তাহাদের আবার আর এক রকমে সন্তান হয়। এই সময়ে ইহাদের প্রত্যেকের শরীরের গােড়ার একটা জায়গা ফুলিয়া উঠে এবং সেখানে অনেক ডিম জন্মে। সঙ্গে সঙ্গে মুখের কাছে একটা জায়গা ফুলিয়া উঠে এবং সেখানেও এক রকম জিনিস জমিতে থাকে। পরে কোনাে গতিকে ইহা শরীরের গোড়ার ডিমে আসিয়া ঠেকিলে, ডিমগুলি বাড়িতে আরম্ভ করে। শীতে হাইড্রারা মরিয়া যায়, কিন্তু ডিমগুলি মরে না। শীতের শেষে একটু গরম পড়িলেই, সেগুলি ফুটিয়া উঠে এবং ইহাতে অনেক নূতন হাইড্রা জন্মে।
হাইড্রাদের জন্মের সঙ্গে লাউ কুমড়া প্রভৃতি গাছে ফল জন্মানোর অনেকটা মিল আছে। তাল, পেঁপে প্রভৃতি গাছের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে। এই-সকল গাছের মধ্যে কতকগুলি পুরুষ এবং কতক স্ত্রী হইয়া জন্মে। পুরুষ-গাছে যে-সকল ফুল ধরে, তাহাতে ফল হয় না; স্ত্রী-গাছের ফুলই শেষে ফল হইয়া দাঁড়ায়। কিন্তু স্ত্রী-গাছের ফুলে ফল হইতে হইলে, পুরুষ-গাছের ফুলের রেণু স্ত্রী ফুলের উপরে আসিয়া পড়া দরকার। পুরুষ-গাছের রেণু স্ত্রী-গাছের ফুলে বাতাসে উড়িয়া আসিয়া পড়ে, বা প্রজাপতিতে বহিয়া আনে। ইহাতে স্ত্রী-ফুলে ফল হয়। লাউ, কুমড়া, শশা প্রভৃতি গাছের স্ত্রী পুরুষ ভেদ নাই। ইহাদের প্রত্যেক গাছেই স্ত্রী-ফুল ও পুরুষ-ফুল ফোটে। তার পরে, পুরুষ-ফুলের রেণু স্ত্রী-ফুলে আসিয়া ঠেকিলেই তাহাতে ফল ধরিতে আরম্ভ করে। হাইড্রাদের সন্তান হওয়া, লাউ কুমড়া প্রভৃতির ফল ধরার মত নয় কি? দেহের গোড়ার ডিমগুলিতে তাহার মুখের কাছে সঞ্চিত সেই জিনিসটা আসিয়া না ঠেকিলে, ডিম হইতে সন্তান হয় না।
৩.২ রাবণচ্ছত্র
রাবণচ্ছত্র